বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫
বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫
মিরর বাংলা

ছোট গল্প- তোমার নামের গন্ধ


অরণ্য জুয়েল
অরণ্য জুয়েল
প্রকাশ : ২৫ অক্টোবর ২০২৫

ছোট গল্প- তোমার নামের গন্ধ

তোমার নামের গন্ধ-০১

“যে বিকেলে নামল অচেনা আলো”

---------------------------------------

শহরের আকাশে সেদিন বিকেলটা যেন একটু অন্যরকম ছিল।

রোদে হালকা কুয়াশার আস্তরণ, আর বাতাসে এমন এক গন্ধ—যেটাকে বলা যায় না, কেবল অনুভব করা যায়।

অনিন্দ্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে কফির কাপ, চোখে ক্লান্ত সময়।

কাপে ধোঁয়া উঠছিল, ধোঁয়ার ভেতর হারিয়ে যাচ্ছিল কিছু অনুচ্চারিত প্রশ্ন—

ভালোবাসা কি শেষ হয়, নাকি অন্য রূপ নেয়?

আলোর মধ্যে অদ্ভুত এক নরম বিষণ্ণতা।

দূরের রাস্তায় রিকশাগুলো ক্লান্ত, দোকানের সাইনবোর্ডে আলো জ্বলে উঠছে—

যেন শহরটা নিজের একাকীত্ব ঢাকতে ছোট ছোট প্রদীপ জ্বেলে রাখছে।

সেদিন সম্পাদক ফোন করেছিল—

“একটা গল্প লিখো অনিন্দ্য, শহরের গন্ধ নিয়ে।”

অনিন্দ্য হেসে ফেলেছিল—

শহরের গন্ধ মানে তো তনিমা।

তার নাম উচ্চারণ করলেই বাতাসে একরাশ আলো কেঁপে ওঠে।

নামটা নিছক নাম নয়, এক অদৃশ্য উপস্থিতি,

যা না থাকলে মনে হয়—সব ফাঁকা।

সে খাতার প্রথম পাতায় লিখেছিল,

“গন্ধেরও নাম থাকে।”

তারপর থেমে গিয়েছিল।

কারণ নীরবতারও তো শব্দ আছে,

যা কেবল তাদের শোনা যায়, যাদের ভিতরে প্রেম একবার হলেও কেঁপে উঠেছে।

সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারটা তার এখনও মনে আছে—

সাদা দেয়াল, নরম আলো, আর জানালার ওপারে বৃষ্টির গন্ধ।

সেদিন সে পড়েছিল তার ছোটগল্প, ‘নৌকার ধারে।’

গল্পটা ছিল অপেক্ষা নিয়ে—একজন মানুষ, যে নদীর ওপারে তাকিয়ে থাকে,

কিন্তু নদীর অন্য পারে কেউ আছে কি না—তা জানে না।

গল্প শেষে হলে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল।

আর সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে অনিন্দ্য তাকিয়েছিল একজোড়া চোখের দিকে।

সেখানে আলো ছিল, প্রশ্ন ছিল, এবং একরাশ অজানা নরমতা।

সেই চোখের নাম—তনিমা।

সে প্রথমে কিছু বলেনি, পরে এগিয়ে এসে বলেছিল,

“তোমার গল্পে যে অপেক্ষা, সেটা কি কারো জন্য?”

অনিন্দ্য হেসেছিল,

“সম্ভবত। সব অপেক্ষাই তো কারো জন্য, নাম জানি না।”

তনিমা মৃদু গলায় বলেছিল,

“নামের গন্ধ থাকে। নাম না জানলেও চিনে নেওয়া যায়।”

সেই একটিমাত্র কথোপকথন যেন অনিন্দ্যের পৃথিবী উলটে দিল।

সে বুঝল—কিছু মানুষ জীবনে আসে বলার জন্য নয়,

থেকে যাওয়ার জন্য।

তাদের সম্পর্ক ছিল নিঃশব্দ।

একটা অসমাপ্ত কবিতার মতো,

যেখানে ছন্দ আছে, অথচ শেষ লাইন নেই।

কোনোদিন ‘ভালোবাসি’ বলা হয়নি—

তবু সন্ধ্যার হালকা আলোয় তারা হাঁটত,

যেন দুটো ছায়া পাশাপাশি থেকে সময়কে হার মানাতে চায়।

তনিমা একদিন বলেছিল,

“আমি যদি হারিয়ে যাই?”

অনিন্দ্য বলেছিল,

“তোমাকে গল্পে রেখে দেব।”

তনিমা হেসে বলেছিল,

“গল্পে নাম থাকবে?”

“নাম না থাকলেও গন্ধ থাকবে,” অনিন্দ্য বলেছিল।

“আর গন্ধই তো সবচেয়ে স্থায়ী।”

তখনও তারা জানত না—এই কথাগুলোই একদিন তাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়াবে।

মানুষ হারিয়ে গেলে যা থেকে যায়—

সেইটাই হয় গন্ধ, স্মৃতি, আর নামের মধ্যেকার অদৃশ্য সেতুবন্ধন।

তনিমা হারিয়ে গেল এক বিকেলে।

আকাশে মেঘ ছিল না, কিন্তু বাতাসে ছিল অজানা অস্থিরতা।

অনিন্দ্য অপেক্ষা করল, অপেক্ষা করতে করতে বুঝল—

অপেক্ষা কখনো শেষ হয় না, শুধু রূপ বদলায়।

ফোনে রিং আসে, কেউ ধরে না।

বার্তা যায়, উত্তর আসে না।

রাগ করার মতো শক্তিও থাকে না,

কারণ ভালোবাসা যখন সত্যি হয়, তখন রাগ করাও পাপের মতো লাগে।

সে লিখল—

“ভালোবাসা মানে না পাওয়ার অভিশাপ নয়,

বরং সেই না-পাওয়াকে গন্ধের মতো বয়ে বেড়ানো।”

তনিমা হারিয়ে গেলেও, তার গন্ধ রয়ে গেল—

কফির কাপের ধোঁয়ায়, বইয়ের পাতায়,

আর অনিন্দ্যের প্রতিটি নিঃশ্বাসে।

বছর গড়িয়ে গেল।

শহরের ফ্লাইওভার উঠল, দোকানের সাইনবোর্ড বদলাল,

কিন্তু অনিন্দ্যের জীবন থেকে গেল একই বারান্দায়, একই কাপে, একই অপেক্ষায়।

বইমেলায় সে দেখল—নিজের গল্পগ্রন্থ “তোমার নামের গন্ধ” মানুষের হাতে।

সেই মুহূর্তে সে অনুভব করল, তনিমা এখন আর ব্যক্তি নয়, এক গান।

ঠিক তখনই শুনল সেই কণ্ঠ—

“আপনি কি আমার নাম লিখবেন?”

চোখ তুলে দেখল—তনিমা।

বৃষ্টির আলোয় ভেজা মুখে হাসি।

হৃদয়ের ভেতর কোথাও যেন আগ্নেয়গিরির মতো কেঁপে উঠল কিছু।

তনিমা বলল,

“নামের মানে জানেন? কোমলতা।”

অনিন্দ্য মৃদু স্বরে বলল,

“আর কোমলতারও গন্ধ থাকে।”

তনিমা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল,

তারপর নিঃশব্দে বলল—

“গন্ধ দিয়ে নাম চিনতে হয়, নাম দিয়ে গন্ধ নয়।”

বলে চলে গেল ভিড়ের মধ্যে।

অনিন্দ্য দাঁড়িয়ে রইল, বারান্দার বাতাসে ফিসফিস করে বলল—

“তুমি থাকো, তনিমা। নামের গন্ধ হয়ে থাকো।”

-------------------------------------------------------------

অরণ্য জুয়েল


তোমার নামের গন্ধ-০২

না-থাকারও একরকম থাকা আছে

---------------------------------------

তনিমা চলে যাওয়ার পর শহরটা যেন তার কণ্ঠ হারিয়েছে।

বাতাস এখনও বইছে, রিকশার ঘণ্টা বাজছে, দোকানের আলো জ্বলছে ঠিকই,

কিন্তু এই শহর আর আগের মতো শ্বাস নিচ্ছে না।

অনিন্দ্য যখন হাঁটে, মনে হয় তার পায়ের ছায়া ভারী হয়ে গেছে।

বৃষ্টির পরের মাটির গন্ধ, বইয়ের পাতায় আটকে থাকা শব্দ,

সবকিছুতেই কোথাও না কোথাও তনিমা থেকে গেছে —

অদৃশ্য, অথচ অনুভবযোগ্য।

সে এখন জানে,

কিছু মানুষ চলে গেলে তাদের অনুপস্থিতি হয়ে ওঠে সবচেয়ে পূর্ণ উপস্থিতি।

রাতে টেবিলে বসে গল্প লিখতে গিয়ে তার কলম থেমে যায়।

বাক্য শুরু হয়, শেষ হয় না।

শব্দগুলো তার কাছে বোধহয় ক্লান্ত হয়ে গেছে।

তবু একসময় সে লিখে ফেলে—

“ভালোবাসা মানে কাউকে পাওয়া নয়,

বরং তার না-থাকাকে নিজের ভেতরে রেখে বেঁচে থাকার সাহস।”

এই লাইনটা লেখা মানেই বুকের মধ্যে কেঁপে ওঠা একটা মৃদু ভূমিকম্প।

মনে হয়—ভালোবাসা মানুষকে ধ্বংস করে না,

তাকে বদলে দেয়,

তাকে এমন কেউ বানায়, যে অন্ধকারেও গন্ধ চিনে নিতে পারে।

বছরের পর বছর কেটে যায়।

অনিন্দ্য মাঝে মাঝে পুরোনো ক্যাম্পাসে যায়—

একটা বেঞ্চে বসে থাকে, যেখানে একসময় তনিমা বসত।

বাতাস এলেই মনে হয় কেউ কানের কাছে বলছে,

“নামের গন্ধ থাকে…”

চোখ বন্ধ করে সে হাসে।

কারণ এখন তার কাছে গন্ধ মানেই তনিমা।

তনিমা মানেই এক ধরণের বাতাস,

যেটা তার ফুসফুসে থাকে, কিন্তু দেখা যায় না।

রাতে সে ঘুমোতে পারে না।

জানালার বাইরে চাঁদ, ভিতরে নরম আলো।

অনিন্দ্য মনে মনে ভাবে,

হয়তো প্রেমের আসল রূপ শরীরে নয়,

নিঃশ্বাসে।

যাকে ভালোবাসা হয়, সে একসময় নিঃশ্বাসে মিশে যায়।

একদিন হঠাৎ ইনবক্সে এক মেইল।

বিষয়: “তোমার গল্পে আমি এখনো আছি।”

চিঠিটা খোলার সময় হাত কাঁপে।

চোখের ভেতর আলো জমে ওঠে।

“আমি তোমার গল্পগুলো পড়ি এখনও।

জানো, প্রতিটি চরিত্রেই একটু করে আমি আছি।”

দুই লাইন, কিন্তু যেন পুরো একটা জীবন।

চিঠির শেষে কোনো নাম নেই,

তবু প্রতিটি অক্ষর যেন তনিমার কণ্ঠে লেখা।

অনিন্দ্য উত্তর দেয় না।

ল্যাপটপ বন্ধ করে ধীরে বলে,

“থাকো, তনিমা।

না-থাকারও তো একরকম থাকা আছে।”

এরপর থেকে তার গল্পে তনিমা ঢুকে যায় ধীরে ধীরে।

কখনো নদীর ধারে এক ছায়া,

কখনো জানালার ধারে এক বাতাস।

সম্পাদক বলে, “তোমার ভাষা বদলে গেছে।”

অনিন্দ্য মাথা নাড়ে—

“ভাষা বদলায় না, গন্ধের রঙ বদলায়।”

সে লিখে ফেলে—

“ভালোবাসা মানে প্রতিদিন একটু একটু করে হারানো,

তবু প্রতিদিন একটু একটু করে বেঁচে থাকা।”

বৃষ্টির রাতে অনিন্দ্য জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।

ফোঁটা পড়ে একের পর এক,

যেন সময়ের নিজস্ব বর্ণমালা।

হঠাৎ মনে হয়—তনিমা পাশে আছে।

তার গন্ধ, তার নিঃশ্বাস, তার নীরবতা সব মিলেমিশে গেছে বৃষ্টির সঙ্গে।

সে ধীরে চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে বলে,

“তুমি কোথায়?”

বাতাস উত্তর দেয়—

“এখানেই তো… না-থাকারও একরকম থাকা আছে।”

রাতের শেষে অনিন্দ্য খাতায় লিখে রাখে—

“ভালোবাসা মানে যে চলে গেছে,

তাকে প্রতিদিন নতুনভাবে ফিরে পাওয়া—

গন্ধ হয়ে, স্মৃতি হয়ে, নিঃশ্বাস হয়ে।”

তারপর খাতা বন্ধ করে দেয়।

বাতাসে তখন কেবল একটিই নামের গন্ধ—

তনিমা।

-------------------------------------------------------------

তোমার নামের গন্ধ-০৩

সময়ের থেমে থাকা বিকেল

---------------------------------------

বছরের পর বছর কেটে গেছে।

সময় অনেক দূর চলে গেছে, কিন্তু অনিন্দ্যের ঘড়িটা যেন থেমে আছে সেই বিকেলের ঠিক পরেই—

যেদিন তনিমা শেষবার তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,

“যদি আমি হারিয়ে যাই, মনে রেখো—ভালোবাসা মানে রয়ে যাওয়া।”

শহর বদলেছে। রাস্তায় নতুন আলো, নতুন মুখ, নতুন ক্লান্তি।

তবু বারান্দার বাতাসে তনিমার গন্ধ রয়ে গেছে।

অনিন্দ্য প্রতিদিন কফির কাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকে,

মনে হয়—যদি হঠাৎ পিছন থেকে কেউ ডাকে,

সে নামটা আবার শুনতে পাবে।

সেই দিনটি ছিল একদম নিরীহ এক শুক্রবার।

বইমেলায় মানুষ ঢলেছে—

বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধ, পাতা উল্টানোর শব্দ,

আর এক ধরনের অকারণ আনন্দের ভেতরে বিষণ্ণতা।

অনিন্দ্য স্টলের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের বইতে সই দিচ্ছিল।

বইটার নাম—“না-থাকারও একরকম থাকা আছে।”

হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলল—

“আপনি কি অনিন্দ্য সেন?”

কণ্ঠটা চেনা, তবু ভুলে যাওয়া কণ্ঠের মতো।

সে ঘুরে তাকাল।

তনিমা দাঁড়িয়ে আছে।

সময়ের মুখ নেই, কিন্তু তখন মনে হয়েছিল, সময় দাঁড়িয়ে পড়েছে।

ভিড়, কোলাহল, আলো—সব নিস্তব্ধ।

শুধু একটা মুখ, যাকে মনে হয়েছিল চিরকাল চেনা,

যেন পৃথিবী এভাবে একবারই তৈরি করতে পেরেছিল।

তনিমা বলল,

“তোমার গল্পে আমি এখনও আছি।”

অনিন্দ্য ধীরে বলল,

“আর আমি তোমার নিঃশ্বাসে।”

তারা একসঙ্গে বসে পড়ল এক কোণে,

চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছিল, কিন্তু কথার দরকার হচ্ছিল না।

তনিমার চোখে ছিল সেই পুরোনো মেঘলা আলো,

যেখানে এক ফোঁটা জল আর একটুখানি হাসি একসঙ্গে বাস করে।

তনিমা বলল,

“তুমি জানো, আমি কেন হারিয়ে গিয়েছিলাম?”

অনিন্দ্য চুপ করে তাকিয়ে রইল।

“ভয় পেয়েছিলাম,” তনিমা বলল,

“ভালোবাসা এতটা গভীর হয়ে গেলে মানুষ টেকে না।

আমি ভাবতাম, আমি তোমাকে ভেঙে ফেলব।”

অনিন্দ্য হাসল, সেই পুরোনো সুরে—

“তুমি ভুল করেছিলে, তনিমা।

মানুষ ভাঙে না, বদলায়।

তোমার না-থাকা আমাকে অন্যরকম করে দিয়েছে।”

তনিমা মৃদু কণ্ঠে বলল,

“তুমি এখনও তেমনই আছো—

সেই শান্ত চোখ, অথচ ভিতরে তোলপাড়।”

অনিন্দ্য বলল,

“তুমি এখনও সেই গন্ধ, যাকে আমি বাতাসে খুঁজি।”

এক মুহূর্তে তারা দুজনেই চুপ।

শুধু বৃষ্টি পড়ছে।

বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা যেন তাদের দুজনের মধ্যে জমে থাকা সব শব্দ মুছে দিচ্ছে।

তনিমা হঠাৎ বলল,

“তুমি জানো, ভালোবাসা আসলে কী?”

“জানি না,” অনিন্দ্য বলল, “হয়তো সময় থামিয়ে রাখার চেষ্টা।”

“না,” তনিমা বলল,

“ভালোবাসা মানে, সময় থেমে গেলে শ্বাস নিতে পারা।”

বৃষ্টির জল তনিমার চুল বেয়ে কাঁধে গড়িয়ে পড়ছিল।

অনিন্দ্য ধীরে হাত বাড়িয়ে তার চুলের একগোছা সরিয়ে দিল।

তনিমা চোখ বন্ধ করল।

মুহূর্তটা একদম নীরব—

শুধু দুটি হৃদয়ের শব্দ,

যা সময়েরও বাইরে চলে গেছে।

তনিমা ফিসফিস করে বলল,

“এই মুহূর্তে আমি তোমার গল্প নই… আমি সত্যি।”

অনিন্দ্য কিছু বলল না।

সে শুধু তার হাত দুটো নিজের বুকে টেনে নিল,

আর মনে হলো, পৃথিবীটা এখন তার বুকের ভেতরে গুটিয়ে গেছে।

বৃষ্টি পড়ছে বাইরে,

কিন্তু তাদের মধ্যে তখন কেবল একটাই শব্দ—

হৃদয়ের স্পন্দন।

তারা জানত, এই দেখা হয়তো শেষ দেখা।

তবু তাদের চোখে কোনো ভয় নেই।

কারণ ভালোবাসা শেষ হয়ে গেলে ভয় থাকে,

আর তারা জানে—

তাদের ভালোবাসা শেষ হয়নি, শুধু রূপ বদলেছে।

তনিমা বলল,

“আমরা যদি আবার হারিয়ে যাই?”

অনিন্দ্য বলল,

“তাহলে আমি তোমার নাম বাতাসে লিখে রাখব।”

তনিমা হেসে বলল,

“বাতাসে লেখা মুছে যায়।”

“না,” অনিন্দ্য বলল, “বাতাসে লেখা জিনিস গন্ধ হয়ে থাকে।”

তনিমা হেসে মাথা রাখল অনিন্দ্যের কাঁধে।

তখন বিকেল থেমে গেল।

ঘড়ির কাঁটা চলছিল, কিন্তু সময় থেমে ছিল—

দুজন মানুষের নিঃশ্বাসে।

সেই বিকেলই হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ বিকেল।

যেখানে ভালোবাসা আর হারিয়ে যাওয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল তারা,

দুজনেই জানত—সময় আবার চলবে,

কিন্তু তাদের সেই মুহূর্ত চিরকাল থেমে থাকবে।

-------------------------------------------------------------

তোমার নামের গন্ধ-০৪

যে সন্ধ্যায় গন্ধ হয়ে ফেরে ভালোবাসা

---------------------------------------

বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু বাতাসে তার শব্দ রয়ে গেছে—

যেমন প্রেম থেমে গেলেও তার ধ্বনি থেকে যায় মানুষের ভিতরে।

অনিন্দ্য আর তনিমা হাঁটছিল ধীর পায়ে।

শহরের রাস্তাগুলো ভিজে চকচক করছে,

আলোর ছায়ায় জলে পড়ে থাকা শেফালির গন্ধে ভরে গেছে চারদিক।

তনিমা হঠাৎ বলল,

“তুমি জানো, সময় একমাত্র জিনিস যা থামে না।”

অনিন্দ্য হাসল—

“কিন্তু প্রেম পারে।

প্রেম যখন সত্যি হয়, সময় থেমে যায়,

যেমন আজ।”

তনিমা তাকিয়ে রইল,

তার চোখে ছিল আলোর ভেতরে ছায়া, আর ছায়ার ভেতরে আলো।

কয়েকদিন তারা এভাবেই দেখা করত—

চুপচাপ, দীর্ঘ, অসমাপ্ত বিকেলগুলোয়।

কথা নয়, নীরবতা বলত বেশি।

কখনো এক কাপ চায়ের ধোঁয়ায়,

কখনো বাতাসে ভেসে থাকা তার চুলের গন্ধে।

কিন্তু তনিমা এখন আগের মতো নয়।

তার চোখে অস্থিরতা আছে, ঠোঁটে দ্বিধা।

সে যেন এক গোপন সময়ের সঙ্গে লড়ছে।

অনিন্দ্য একদিন জিজ্ঞেস করল,

“তুমি কিছু লুকাচ্ছো?”

তনিমা চুপ করে ছিল অনেকক্ষণ।

তারপর মৃদু স্বরে বলল,

“আমি যাচ্ছি, অনিন্দ্য।

এবার চিরতরে।”

অনিন্দ্য কিছু বলতে গেল,

কিন্তু শব্দ বেরোলো না।

শুধু বুকের ভেতর একটা তীব্র আলোড়ন,

যেন কেউ হৃদয়ের ওপর হাত রেখে বলল—“এটাই শেষ।”

তনিমা বলল,

“তুমি জানো, ভালোবাসা কখনো মরে না।

সে শুধু শরীর বদলায়—

বাতাস হয়, গন্ধ হয়, স্মৃতি হয়।”

তারপর সে এগিয়ে এসে অনিন্দ্যের বুকের উপর মাথা রাখল।

বৃষ্টি শুরু হয়েছিল আবার।

তার চুলে, গায়ে, নিঃশ্বাসে ভিজে উঠেছিল অনিন্দ্যের আঙুল।

মুহূর্তটা নরম, অথচ অসহনীয় তীব্র।

অনিন্দ্য অনুভব করল—

যে মানুষকে এতদিন কল্পনায় জড়িয়ে ছিল,

সে আজ বাস্তব, কিন্তু অচিরেই অদৃশ্য হয়ে যাবে।

তনিমা ফিসফিস করে বলল,

“আমি যদি থাকি না, তবু থাকব—

তোমার গল্পে, তোমার গন্ধে, তোমার নিঃশ্বাসে।”

অনিন্দ্য চোখ বন্ধ করল।

তার বুকের ভেতর একসঙ্গে বাজছিল প্রেম, ভয়, আর শান্তি।

সে কিছুই বলল না—শুধু নিঃশ্বাস নিল গভীর করে,

যেন তনিমাকে নিজের ভেতর রেখে দিল সারাজীবনের জন্য।

সেই রাতে তনিমা হারিয়ে গেল।

না কোনো বিদায়, না কোনো বার্তা।

শুধু জানালার ফাঁক দিয়ে এলো এক চেনা গন্ধ—

ভেজা চুলের, বৃষ্টির, আর অনুপস্থিতির গন্ধ।

অনিন্দ্য জানল—তনিমা চলে গেছে।

তবু তার বুকের ভেতর এক আশ্চর্য শান্তি নেমে এলো।

কারণ এখন সে জানে, ভালোবাসা চলে যায় না,

সে কেবল বাতাস হয়ে ফিসফিস করে বলে—“আমি আছি।”

বছর কেটে গেল।

অনিন্দ্যের নতুন বই বেরোল—

“তোমার নামের গন্ধ।”

বইমেলায় কেউ বলল,

“এই বইয়ে যেন বৃষ্টির গন্ধ আছে।”

কেউ বলল,

“এই গল্পে কেউ হারিয়ে থেকেও আছে।”

অনিন্দ্য মৃদু হাসল—

“হয়তো সত্যিই আছে—তনিমা, গন্ধ হয়ে।”

রাতে বাড়ি ফিরে সে বারান্দায় বসে।

আকাশে হালকা মেঘ, বাতাসে বৃষ্টি।

হঠাৎ একখানা খাম—ডাকবাক্সে।

খামের ভেতরে লেখা, তনিমার হাতের অক্ষরে—

“তুমি জানো, আমি হারিয়ে যাইনি।

আমি কেবল গন্ধ হয়ে গেছি।

যখন তোমার গল্প লিখবে,

বাতাসে নিঃশ্বাস নিলে আমি সেখানে থাকব।”

ভেতরে ছিল এক শুকনো ফুল—শেফালি।

অনিন্দ্য ফুলটা খাতার ভেতরে রেখে দিল,

ঠিক প্রথম পাতার ওপরে—যেখানে লেখা ছিল,

“গন্ধেরও নাম থাকে।”

বাতাস বয়ে গেল।

অনিন্দ্য চোখ বন্ধ করল।

তার মনে হলো, কেউ চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে,

কেউ খুব কাছ থেকে ফিসফিস করছে—

“আমি আছি, অনিন্দ্য।”

সে হাসল, মৃদু, নিঃশব্দে।

তার চোখে জল এল, কিন্তু সেটা দুঃখের নয়—

ওটা ছিল এক অদ্ভুত শান্তি,

যা কেবল প্রেমের পরের স্তরে পাওয়া যায়।

“ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না,” সে লিখল,

“শুধু রূপ বদলায়—শরীর থেকে নিঃশ্বাসে,

নাম থেকে গন্ধে,

মানুষ থেকে গল্পে।”

আর সেই সন্ধ্যায়,

যখন আলো নিভে যাচ্ছিল, বাতাসে বৃষ্টি মিশছিল,

তখন ভালোবাসা আবার ফিরে এলো—

গন্ধ হয়ে, সময়ের ওপারে, গল্পের ভেতরে।

আপনার মতামত লিখুন

মিরর বাংলা

বুধবার, ০৫ নভেম্বর ২০২৫


ছোট গল্প- তোমার নামের গন্ধ

প্রকাশের তারিখ : ২৫ অক্টোবর ২০২৫

featured Image

তোমার নামের গন্ধ-০১

“যে বিকেলে নামল অচেনা আলো”

---------------------------------------

শহরের আকাশে সেদিন বিকেলটা যেন একটু অন্যরকম ছিল।

রোদে হালকা কুয়াশার আস্তরণ, আর বাতাসে এমন এক গন্ধ—যেটাকে বলা যায় না, কেবল অনুভব করা যায়।

অনিন্দ্য বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল, হাতে কফির কাপ, চোখে ক্লান্ত সময়।

কাপে ধোঁয়া উঠছিল, ধোঁয়ার ভেতর হারিয়ে যাচ্ছিল কিছু অনুচ্চারিত প্রশ্ন—

ভালোবাসা কি শেষ হয়, নাকি অন্য রূপ নেয়?

আলোর মধ্যে অদ্ভুত এক নরম বিষণ্ণতা।

দূরের রাস্তায় রিকশাগুলো ক্লান্ত, দোকানের সাইনবোর্ডে আলো জ্বলে উঠছে—

যেন শহরটা নিজের একাকীত্ব ঢাকতে ছোট ছোট প্রদীপ জ্বেলে রাখছে।

সেদিন সম্পাদক ফোন করেছিল—

“একটা গল্প লিখো অনিন্দ্য, শহরের গন্ধ নিয়ে।”

অনিন্দ্য হেসে ফেলেছিল—

শহরের গন্ধ মানে তো তনিমা।

তার নাম উচ্চারণ করলেই বাতাসে একরাশ আলো কেঁপে ওঠে।

নামটা নিছক নাম নয়, এক অদৃশ্য উপস্থিতি,

যা না থাকলে মনে হয়—সব ফাঁকা।

সে খাতার প্রথম পাতায় লিখেছিল,

“গন্ধেরও নাম থাকে।”

তারপর থেমে গিয়েছিল।

কারণ নীরবতারও তো শব্দ আছে,

যা কেবল তাদের শোনা যায়, যাদের ভিতরে প্রেম একবার হলেও কেঁপে উঠেছে।

সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সেমিনারটা তার এখনও মনে আছে—

সাদা দেয়াল, নরম আলো, আর জানালার ওপারে বৃষ্টির গন্ধ।

সেদিন সে পড়েছিল তার ছোটগল্প, ‘নৌকার ধারে।’

গল্পটা ছিল অপেক্ষা নিয়ে—একজন মানুষ, যে নদীর ওপারে তাকিয়ে থাকে,

কিন্তু নদীর অন্য পারে কেউ আছে কি না—তা জানে না।

গল্প শেষে হলে নিস্তব্ধতা নেমে এসেছিল।

আর সেই নিস্তব্ধতার মধ্যে অনিন্দ্য তাকিয়েছিল একজোড়া চোখের দিকে।

সেখানে আলো ছিল, প্রশ্ন ছিল, এবং একরাশ অজানা নরমতা।

সেই চোখের নাম—তনিমা।

সে প্রথমে কিছু বলেনি, পরে এগিয়ে এসে বলেছিল,

“তোমার গল্পে যে অপেক্ষা, সেটা কি কারো জন্য?”

অনিন্দ্য হেসেছিল,

“সম্ভবত। সব অপেক্ষাই তো কারো জন্য, নাম জানি না।”

তনিমা মৃদু গলায় বলেছিল,

“নামের গন্ধ থাকে। নাম না জানলেও চিনে নেওয়া যায়।”

সেই একটিমাত্র কথোপকথন যেন অনিন্দ্যের পৃথিবী উলটে দিল।

সে বুঝল—কিছু মানুষ জীবনে আসে বলার জন্য নয়,

থেকে যাওয়ার জন্য।

তাদের সম্পর্ক ছিল নিঃশব্দ।

একটা অসমাপ্ত কবিতার মতো,

যেখানে ছন্দ আছে, অথচ শেষ লাইন নেই।

কোনোদিন ‘ভালোবাসি’ বলা হয়নি—

তবু সন্ধ্যার হালকা আলোয় তারা হাঁটত,

যেন দুটো ছায়া পাশাপাশি থেকে সময়কে হার মানাতে চায়।

তনিমা একদিন বলেছিল,

“আমি যদি হারিয়ে যাই?”

অনিন্দ্য বলেছিল,

“তোমাকে গল্পে রেখে দেব।”

তনিমা হেসে বলেছিল,

“গল্পে নাম থাকবে?”

“নাম না থাকলেও গন্ধ থাকবে,” অনিন্দ্য বলেছিল।

“আর গন্ধই তো সবচেয়ে স্থায়ী।”

তখনও তারা জানত না—এই কথাগুলোই একদিন তাদের নিয়তি হয়ে দাঁড়াবে।

মানুষ হারিয়ে গেলে যা থেকে যায়—

সেইটাই হয় গন্ধ, স্মৃতি, আর নামের মধ্যেকার অদৃশ্য সেতুবন্ধন।

তনিমা হারিয়ে গেল এক বিকেলে।

আকাশে মেঘ ছিল না, কিন্তু বাতাসে ছিল অজানা অস্থিরতা।

অনিন্দ্য অপেক্ষা করল, অপেক্ষা করতে করতে বুঝল—

অপেক্ষা কখনো শেষ হয় না, শুধু রূপ বদলায়।

ফোনে রিং আসে, কেউ ধরে না।

বার্তা যায়, উত্তর আসে না।

রাগ করার মতো শক্তিও থাকে না,

কারণ ভালোবাসা যখন সত্যি হয়, তখন রাগ করাও পাপের মতো লাগে।

সে লিখল—

“ভালোবাসা মানে না পাওয়ার অভিশাপ নয়,

বরং সেই না-পাওয়াকে গন্ধের মতো বয়ে বেড়ানো।”

তনিমা হারিয়ে গেলেও, তার গন্ধ রয়ে গেল—

কফির কাপের ধোঁয়ায়, বইয়ের পাতায়,

আর অনিন্দ্যের প্রতিটি নিঃশ্বাসে।

বছর গড়িয়ে গেল।

শহরের ফ্লাইওভার উঠল, দোকানের সাইনবোর্ড বদলাল,

কিন্তু অনিন্দ্যের জীবন থেকে গেল একই বারান্দায়, একই কাপে, একই অপেক্ষায়।

বইমেলায় সে দেখল—নিজের গল্পগ্রন্থ “তোমার নামের গন্ধ” মানুষের হাতে।

সেই মুহূর্তে সে অনুভব করল, তনিমা এখন আর ব্যক্তি নয়, এক গান।

ঠিক তখনই শুনল সেই কণ্ঠ—

“আপনি কি আমার নাম লিখবেন?”

চোখ তুলে দেখল—তনিমা।

বৃষ্টির আলোয় ভেজা মুখে হাসি।

হৃদয়ের ভেতর কোথাও যেন আগ্নেয়গিরির মতো কেঁপে উঠল কিছু।

তনিমা বলল,

“নামের মানে জানেন? কোমলতা।”

অনিন্দ্য মৃদু স্বরে বলল,

“আর কোমলতারও গন্ধ থাকে।”

তনিমা কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল,

তারপর নিঃশব্দে বলল—

“গন্ধ দিয়ে নাম চিনতে হয়, নাম দিয়ে গন্ধ নয়।”

বলে চলে গেল ভিড়ের মধ্যে।

অনিন্দ্য দাঁড়িয়ে রইল, বারান্দার বাতাসে ফিসফিস করে বলল—

“তুমি থাকো, তনিমা। নামের গন্ধ হয়ে থাকো।”

-------------------------------------------------------------

অরণ্য জুয়েল


তোমার নামের গন্ধ-০২

না-থাকারও একরকম থাকা আছে

---------------------------------------

তনিমা চলে যাওয়ার পর শহরটা যেন তার কণ্ঠ হারিয়েছে।

বাতাস এখনও বইছে, রিকশার ঘণ্টা বাজছে, দোকানের আলো জ্বলছে ঠিকই,

কিন্তু এই শহর আর আগের মতো শ্বাস নিচ্ছে না।

অনিন্দ্য যখন হাঁটে, মনে হয় তার পায়ের ছায়া ভারী হয়ে গেছে।

বৃষ্টির পরের মাটির গন্ধ, বইয়ের পাতায় আটকে থাকা শব্দ,

সবকিছুতেই কোথাও না কোথাও তনিমা থেকে গেছে —

অদৃশ্য, অথচ অনুভবযোগ্য।

সে এখন জানে,

কিছু মানুষ চলে গেলে তাদের অনুপস্থিতি হয়ে ওঠে সবচেয়ে পূর্ণ উপস্থিতি।

রাতে টেবিলে বসে গল্প লিখতে গিয়ে তার কলম থেমে যায়।

বাক্য শুরু হয়, শেষ হয় না।

শব্দগুলো তার কাছে বোধহয় ক্লান্ত হয়ে গেছে।

তবু একসময় সে লিখে ফেলে—

“ভালোবাসা মানে কাউকে পাওয়া নয়,

বরং তার না-থাকাকে নিজের ভেতরে রেখে বেঁচে থাকার সাহস।”

এই লাইনটা লেখা মানেই বুকের মধ্যে কেঁপে ওঠা একটা মৃদু ভূমিকম্প।

মনে হয়—ভালোবাসা মানুষকে ধ্বংস করে না,

তাকে বদলে দেয়,

তাকে এমন কেউ বানায়, যে অন্ধকারেও গন্ধ চিনে নিতে পারে।

বছরের পর বছর কেটে যায়।

অনিন্দ্য মাঝে মাঝে পুরোনো ক্যাম্পাসে যায়—

একটা বেঞ্চে বসে থাকে, যেখানে একসময় তনিমা বসত।

বাতাস এলেই মনে হয় কেউ কানের কাছে বলছে,

“নামের গন্ধ থাকে…”

চোখ বন্ধ করে সে হাসে।

কারণ এখন তার কাছে গন্ধ মানেই তনিমা।

তনিমা মানেই এক ধরণের বাতাস,

যেটা তার ফুসফুসে থাকে, কিন্তু দেখা যায় না।

রাতে সে ঘুমোতে পারে না।

জানালার বাইরে চাঁদ, ভিতরে নরম আলো।

অনিন্দ্য মনে মনে ভাবে,

হয়তো প্রেমের আসল রূপ শরীরে নয়,

নিঃশ্বাসে।

যাকে ভালোবাসা হয়, সে একসময় নিঃশ্বাসে মিশে যায়।

একদিন হঠাৎ ইনবক্সে এক মেইল।

বিষয়: “তোমার গল্পে আমি এখনো আছি।”

চিঠিটা খোলার সময় হাত কাঁপে।

চোখের ভেতর আলো জমে ওঠে।

“আমি তোমার গল্পগুলো পড়ি এখনও।

জানো, প্রতিটি চরিত্রেই একটু করে আমি আছি।”

দুই লাইন, কিন্তু যেন পুরো একটা জীবন।

চিঠির শেষে কোনো নাম নেই,

তবু প্রতিটি অক্ষর যেন তনিমার কণ্ঠে লেখা।

অনিন্দ্য উত্তর দেয় না।

ল্যাপটপ বন্ধ করে ধীরে বলে,

“থাকো, তনিমা।

না-থাকারও তো একরকম থাকা আছে।”

এরপর থেকে তার গল্পে তনিমা ঢুকে যায় ধীরে ধীরে।

কখনো নদীর ধারে এক ছায়া,

কখনো জানালার ধারে এক বাতাস।

সম্পাদক বলে, “তোমার ভাষা বদলে গেছে।”

অনিন্দ্য মাথা নাড়ে—

“ভাষা বদলায় না, গন্ধের রঙ বদলায়।”

সে লিখে ফেলে—

“ভালোবাসা মানে প্রতিদিন একটু একটু করে হারানো,

তবু প্রতিদিন একটু একটু করে বেঁচে থাকা।”

বৃষ্টির রাতে অনিন্দ্য জানালার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে।

ফোঁটা পড়ে একের পর এক,

যেন সময়ের নিজস্ব বর্ণমালা।

হঠাৎ মনে হয়—তনিমা পাশে আছে।

তার গন্ধ, তার নিঃশ্বাস, তার নীরবতা সব মিলেমিশে গেছে বৃষ্টির সঙ্গে।

সে ধীরে চোখ বন্ধ করে ফিসফিস করে বলে,

“তুমি কোথায়?”

বাতাস উত্তর দেয়—

“এখানেই তো… না-থাকারও একরকম থাকা আছে।”

রাতের শেষে অনিন্দ্য খাতায় লিখে রাখে—

“ভালোবাসা মানে যে চলে গেছে,

তাকে প্রতিদিন নতুনভাবে ফিরে পাওয়া—

গন্ধ হয়ে, স্মৃতি হয়ে, নিঃশ্বাস হয়ে।”

তারপর খাতা বন্ধ করে দেয়।

বাতাসে তখন কেবল একটিই নামের গন্ধ—

তনিমা।

-------------------------------------------------------------

তোমার নামের গন্ধ-০৩

সময়ের থেমে থাকা বিকেল

---------------------------------------

বছরের পর বছর কেটে গেছে।

সময় অনেক দূর চলে গেছে, কিন্তু অনিন্দ্যের ঘড়িটা যেন থেমে আছে সেই বিকেলের ঠিক পরেই—

যেদিন তনিমা শেষবার তার চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল,

“যদি আমি হারিয়ে যাই, মনে রেখো—ভালোবাসা মানে রয়ে যাওয়া।”

শহর বদলেছে। রাস্তায় নতুন আলো, নতুন মুখ, নতুন ক্লান্তি।

তবু বারান্দার বাতাসে তনিমার গন্ধ রয়ে গেছে।

অনিন্দ্য প্রতিদিন কফির কাপ হাতে দাঁড়িয়ে থাকে,

মনে হয়—যদি হঠাৎ পিছন থেকে কেউ ডাকে,

সে নামটা আবার শুনতে পাবে।

সেই দিনটি ছিল একদম নিরীহ এক শুক্রবার।

বইমেলায় মানুষ ঢলেছে—

বৃষ্টিভেজা মাটির গন্ধ, পাতা উল্টানোর শব্দ,

আর এক ধরনের অকারণ আনন্দের ভেতরে বিষণ্ণতা।

অনিন্দ্য স্টলের পাশে দাঁড়িয়ে নিজের বইতে সই দিচ্ছিল।

বইটার নাম—“না-থাকারও একরকম থাকা আছে।”

হঠাৎ পেছন থেকে কেউ বলল—

“আপনি কি অনিন্দ্য সেন?”

কণ্ঠটা চেনা, তবু ভুলে যাওয়া কণ্ঠের মতো।

সে ঘুরে তাকাল।

তনিমা দাঁড়িয়ে আছে।

সময়ের মুখ নেই, কিন্তু তখন মনে হয়েছিল, সময় দাঁড়িয়ে পড়েছে।

ভিড়, কোলাহল, আলো—সব নিস্তব্ধ।

শুধু একটা মুখ, যাকে মনে হয়েছিল চিরকাল চেনা,

যেন পৃথিবী এভাবে একবারই তৈরি করতে পেরেছিল।

তনিমা বলল,

“তোমার গল্পে আমি এখনও আছি।”

অনিন্দ্য ধীরে বলল,

“আর আমি তোমার নিঃশ্বাসে।”

তারা একসঙ্গে বসে পড়ল এক কোণে,

চায়ের কাপে ধোঁয়া উঠছিল, কিন্তু কথার দরকার হচ্ছিল না।

তনিমার চোখে ছিল সেই পুরোনো মেঘলা আলো,

যেখানে এক ফোঁটা জল আর একটুখানি হাসি একসঙ্গে বাস করে।

তনিমা বলল,

“তুমি জানো, আমি কেন হারিয়ে গিয়েছিলাম?”

অনিন্দ্য চুপ করে তাকিয়ে রইল।

“ভয় পেয়েছিলাম,” তনিমা বলল,

“ভালোবাসা এতটা গভীর হয়ে গেলে মানুষ টেকে না।

আমি ভাবতাম, আমি তোমাকে ভেঙে ফেলব।”

অনিন্দ্য হাসল, সেই পুরোনো সুরে—

“তুমি ভুল করেছিলে, তনিমা।

মানুষ ভাঙে না, বদলায়।

তোমার না-থাকা আমাকে অন্যরকম করে দিয়েছে।”

তনিমা মৃদু কণ্ঠে বলল,

“তুমি এখনও তেমনই আছো—

সেই শান্ত চোখ, অথচ ভিতরে তোলপাড়।”

অনিন্দ্য বলল,

“তুমি এখনও সেই গন্ধ, যাকে আমি বাতাসে খুঁজি।”

এক মুহূর্তে তারা দুজনেই চুপ।

শুধু বৃষ্টি পড়ছে।

বৃষ্টির প্রতিটি ফোঁটা যেন তাদের দুজনের মধ্যে জমে থাকা সব শব্দ মুছে দিচ্ছে।

তনিমা হঠাৎ বলল,

“তুমি জানো, ভালোবাসা আসলে কী?”

“জানি না,” অনিন্দ্য বলল, “হয়তো সময় থামিয়ে রাখার চেষ্টা।”

“না,” তনিমা বলল,

“ভালোবাসা মানে, সময় থেমে গেলে শ্বাস নিতে পারা।”

বৃষ্টির জল তনিমার চুল বেয়ে কাঁধে গড়িয়ে পড়ছিল।

অনিন্দ্য ধীরে হাত বাড়িয়ে তার চুলের একগোছা সরিয়ে দিল।

তনিমা চোখ বন্ধ করল।

মুহূর্তটা একদম নীরব—

শুধু দুটি হৃদয়ের শব্দ,

যা সময়েরও বাইরে চলে গেছে।

তনিমা ফিসফিস করে বলল,

“এই মুহূর্তে আমি তোমার গল্প নই… আমি সত্যি।”

অনিন্দ্য কিছু বলল না।

সে শুধু তার হাত দুটো নিজের বুকে টেনে নিল,

আর মনে হলো, পৃথিবীটা এখন তার বুকের ভেতরে গুটিয়ে গেছে।

বৃষ্টি পড়ছে বাইরে,

কিন্তু তাদের মধ্যে তখন কেবল একটাই শব্দ—

হৃদয়ের স্পন্দন।

তারা জানত, এই দেখা হয়তো শেষ দেখা।

তবু তাদের চোখে কোনো ভয় নেই।

কারণ ভালোবাসা শেষ হয়ে গেলে ভয় থাকে,

আর তারা জানে—

তাদের ভালোবাসা শেষ হয়নি, শুধু রূপ বদলেছে।

তনিমা বলল,

“আমরা যদি আবার হারিয়ে যাই?”

অনিন্দ্য বলল,

“তাহলে আমি তোমার নাম বাতাসে লিখে রাখব।”

তনিমা হেসে বলল,

“বাতাসে লেখা মুছে যায়।”

“না,” অনিন্দ্য বলল, “বাতাসে লেখা জিনিস গন্ধ হয়ে থাকে।”

তনিমা হেসে মাথা রাখল অনিন্দ্যের কাঁধে।

তখন বিকেল থেমে গেল।

ঘড়ির কাঁটা চলছিল, কিন্তু সময় থেমে ছিল—

দুজন মানুষের নিঃশ্বাসে।

সেই বিকেলই হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে দীর্ঘ বিকেল।

যেখানে ভালোবাসা আর হারিয়ে যাওয়ার মাঝখানে দাঁড়িয়ে ছিল তারা,

দুজনেই জানত—সময় আবার চলবে,

কিন্তু তাদের সেই মুহূর্ত চিরকাল থেমে থাকবে।

-------------------------------------------------------------

তোমার নামের গন্ধ-০৪

যে সন্ধ্যায় গন্ধ হয়ে ফেরে ভালোবাসা

---------------------------------------

বৃষ্টি থেমে গেছে, কিন্তু বাতাসে তার শব্দ রয়ে গেছে—

যেমন প্রেম থেমে গেলেও তার ধ্বনি থেকে যায় মানুষের ভিতরে।

অনিন্দ্য আর তনিমা হাঁটছিল ধীর পায়ে।

শহরের রাস্তাগুলো ভিজে চকচক করছে,

আলোর ছায়ায় জলে পড়ে থাকা শেফালির গন্ধে ভরে গেছে চারদিক।

তনিমা হঠাৎ বলল,

“তুমি জানো, সময় একমাত্র জিনিস যা থামে না।”

অনিন্দ্য হাসল—

“কিন্তু প্রেম পারে।

প্রেম যখন সত্যি হয়, সময় থেমে যায়,

যেমন আজ।”

তনিমা তাকিয়ে রইল,

তার চোখে ছিল আলোর ভেতরে ছায়া, আর ছায়ার ভেতরে আলো।

কয়েকদিন তারা এভাবেই দেখা করত—

চুপচাপ, দীর্ঘ, অসমাপ্ত বিকেলগুলোয়।

কথা নয়, নীরবতা বলত বেশি।

কখনো এক কাপ চায়ের ধোঁয়ায়,

কখনো বাতাসে ভেসে থাকা তার চুলের গন্ধে।

কিন্তু তনিমা এখন আগের মতো নয়।

তার চোখে অস্থিরতা আছে, ঠোঁটে দ্বিধা।

সে যেন এক গোপন সময়ের সঙ্গে লড়ছে।

অনিন্দ্য একদিন জিজ্ঞেস করল,

“তুমি কিছু লুকাচ্ছো?”

তনিমা চুপ করে ছিল অনেকক্ষণ।

তারপর মৃদু স্বরে বলল,

“আমি যাচ্ছি, অনিন্দ্য।

এবার চিরতরে।”

অনিন্দ্য কিছু বলতে গেল,

কিন্তু শব্দ বেরোলো না।

শুধু বুকের ভেতর একটা তীব্র আলোড়ন,

যেন কেউ হৃদয়ের ওপর হাত রেখে বলল—“এটাই শেষ।”

তনিমা বলল,

“তুমি জানো, ভালোবাসা কখনো মরে না।

সে শুধু শরীর বদলায়—

বাতাস হয়, গন্ধ হয়, স্মৃতি হয়।”

তারপর সে এগিয়ে এসে অনিন্দ্যের বুকের উপর মাথা রাখল।

বৃষ্টি শুরু হয়েছিল আবার।

তার চুলে, গায়ে, নিঃশ্বাসে ভিজে উঠেছিল অনিন্দ্যের আঙুল।

মুহূর্তটা নরম, অথচ অসহনীয় তীব্র।

অনিন্দ্য অনুভব করল—

যে মানুষকে এতদিন কল্পনায় জড়িয়ে ছিল,

সে আজ বাস্তব, কিন্তু অচিরেই অদৃশ্য হয়ে যাবে।

তনিমা ফিসফিস করে বলল,

“আমি যদি থাকি না, তবু থাকব—

তোমার গল্পে, তোমার গন্ধে, তোমার নিঃশ্বাসে।”

অনিন্দ্য চোখ বন্ধ করল।

তার বুকের ভেতর একসঙ্গে বাজছিল প্রেম, ভয়, আর শান্তি।

সে কিছুই বলল না—শুধু নিঃশ্বাস নিল গভীর করে,

যেন তনিমাকে নিজের ভেতর রেখে দিল সারাজীবনের জন্য।

সেই রাতে তনিমা হারিয়ে গেল।

না কোনো বিদায়, না কোনো বার্তা।

শুধু জানালার ফাঁক দিয়ে এলো এক চেনা গন্ধ—

ভেজা চুলের, বৃষ্টির, আর অনুপস্থিতির গন্ধ।

অনিন্দ্য জানল—তনিমা চলে গেছে।

তবু তার বুকের ভেতর এক আশ্চর্য শান্তি নেমে এলো।

কারণ এখন সে জানে, ভালোবাসা চলে যায় না,

সে কেবল বাতাস হয়ে ফিসফিস করে বলে—“আমি আছি।”

বছর কেটে গেল।

অনিন্দ্যের নতুন বই বেরোল—

“তোমার নামের গন্ধ।”

বইমেলায় কেউ বলল,

“এই বইয়ে যেন বৃষ্টির গন্ধ আছে।”

কেউ বলল,

“এই গল্পে কেউ হারিয়ে থেকেও আছে।”

অনিন্দ্য মৃদু হাসল—

“হয়তো সত্যিই আছে—তনিমা, গন্ধ হয়ে।”

রাতে বাড়ি ফিরে সে বারান্দায় বসে।

আকাশে হালকা মেঘ, বাতাসে বৃষ্টি।

হঠাৎ একখানা খাম—ডাকবাক্সে।

খামের ভেতরে লেখা, তনিমার হাতের অক্ষরে—

“তুমি জানো, আমি হারিয়ে যাইনি।

আমি কেবল গন্ধ হয়ে গেছি।

যখন তোমার গল্প লিখবে,

বাতাসে নিঃশ্বাস নিলে আমি সেখানে থাকব।”

ভেতরে ছিল এক শুকনো ফুল—শেফালি।

অনিন্দ্য ফুলটা খাতার ভেতরে রেখে দিল,

ঠিক প্রথম পাতার ওপরে—যেখানে লেখা ছিল,

“গন্ধেরও নাম থাকে।”

বাতাস বয়ে গেল।

অনিন্দ্য চোখ বন্ধ করল।

তার মনে হলো, কেউ চুলে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে,

কেউ খুব কাছ থেকে ফিসফিস করছে—

“আমি আছি, অনিন্দ্য।”

সে হাসল, মৃদু, নিঃশব্দে।

তার চোখে জল এল, কিন্তু সেটা দুঃখের নয়—

ওটা ছিল এক অদ্ভুত শান্তি,

যা কেবল প্রেমের পরের স্তরে পাওয়া যায়।

“ভালোবাসা কখনো শেষ হয় না,” সে লিখল,

“শুধু রূপ বদলায়—শরীর থেকে নিঃশ্বাসে,

নাম থেকে গন্ধে,

মানুষ থেকে গল্পে।”

আর সেই সন্ধ্যায়,

যখন আলো নিভে যাচ্ছিল, বাতাসে বৃষ্টি মিশছিল,

তখন ভালোবাসা আবার ফিরে এলো—

গন্ধ হয়ে, সময়ের ওপারে, গল্পের ভেতরে।


মিরর বাংলা

সম্পাদক ও প্রকাশকঃ মাসুদুল আলম তুষার
কপিরাইট © ২০২৫ মিরর বাংলা । সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত