ডলারের চাপ বেড়েই চলেছে

0
72

দেশের বাজারে ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়নের পরই আলোচনায় মূল্যস্ফীতি। এর প্রভাবে দেশের বাজারে ভোগ্যপণ্য থেকে বিলাসী পণ্য সবকিছুতে দাম বাড়বে। দাম বাড়বে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসহ সেবাখাতেও। এমন পরিস্থিতিতে চাপে পড়বে সাধারণ মানুষ। কারণ অতিরিক্ত মূল্যস্ফীতির কারণে হিমশিম অবস্থা দেখা দেবে জনজীবনে। অন্যদিকে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদনশীল পণ্যেরও দাম বাড়বে। কারণ কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানিতে খরচ বাড়বে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় পোশাকসহ রপ্তানিমুখী পণ্যকে নতুন করে প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হতে হবে। তবে স্বল্প মেয়াদে এর প্রভাব বেশি হলেও দীর্ঘ মেয়াদে ভালো ফল আসতে পারে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। তাই দেশের অর্থনীতি ঠিক রাখতে রপ্তানি বৃদ্ধি ও বৈধ পথে রেমিট্যান্স আহরণে প্রবাসীদের উৎসাহিত করতে বলেন তারা।
ডলারের দাম বৃদ্ধির ফলে দেশের বাজারে এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। সেক্ষেত্রে ভুগতে হবে ভোক্তাদের। বিশেষ করে নিম্নআয়ের মানুষকে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে বেশি। বেসরকারি চাকরিজীবী আব্দুল্লাহ আল নোমান বলেন, ভোগ্যপণ্যের দাম এখনই লাগামছাড়া। ডলারের মূল্য বৃদ্ধির প্রভাবে আমদানি খরচ বেড়ে গেলে বাজারেও এর প্রভাব পড়বে। তখন আয়-ব্যয়ের হিসাব মেলানো কঠিন হয়ে যাবে। তাই দ্রুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্টদের উদ্যোগী হতে হবে।
ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়তে পারে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিখাতে। কারণ দেশের জ্বালানির প্রায় পুরোটাই আমদানিনির্ভর। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদও স্বীকার করেছেন এটি। তিনি বলেন, ডলারের দাম বাড়িয়ে দেয়ায় বিদ্যুৎ-জ্বালানিতে বাড়তি চাপ তৈরি হবে। বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।
ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় কয়লা, গ্যাস, জ্বালানি তেলের মতো আমদানি পণ্যের ব্যয় বাড়বে। তখন এসব পণ্যের দাম বাড়বে। এছাড়াও এসব ব্যবহার করে যেসব পণ্য উৎপাদন করা হয় সেগুলোরও দাম বাড়বে। তখন এর প্রভাব পড়বে বাজারে। অন্যদিকে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর বিলের বড় অংশই পরিশোধ করা হয় ডলারে। এছাড়াও এসব খাতে বকেয়া রয়েছে বিপুল পরিমাণ অর্থ। এমতাবস্থায় বকেয়া পরিশোধে খরচ আরও বেড়ে যাবে। অন্যদিকে সরকার ভর্তুকি দেয়া থেকে যেহেতু বেরিয়ে আসছে সেহেতু বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়বে আবারও। দেখা দিতে পারে বিদ্যুতের ঘাটতি। এলএনজি আমদানিতেও খরচ বাড়বে। এছাড়াও এলপি গ্যাসের কাঁচামাল বিউটেন ও প্রোপেন পুরোটাই আমদানি করতে হয়। তাই দাম বৃদ্ধি পাবে এলপি গ্যাসেরও। ডলারের দাম বৃদ্ধিতে ডিজেল, অকটেন ও পেট্রোলের দামও বাড়তে পারে লিটারে ৬ থেকে ৭ টাকা।
এছাড়াও পোশাকখাতেও কাঁচামালের জন্য বাংলাদেশ আমদানির ওপর নির্ভরশীল। অন্যদিকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়ার সম্ভাবনা থাকায় তৈরি পোশাক উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে তার বাজারমূল্যও বাড়াতে হবে। তখন চ্যালেঞ্জে পড়তে হবে রপ্তানিকারকদের। তবে এর মধ্যেও বাজার ধরে রেখে রপ্তানি বাড়াতে পারলে দেশের অর্থনীতিতে এর সুফল পাওয়া যাবে সবচেয়ে বেশি। একই অবস্থা ওষুধসহ অন্যান্য রপ্তানি পণ্যেও বিরাজ করবে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাজার ঠিক রাখতে উদ্যোগী হতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংকে।
ডলারের বিপরীতে টাকার বড় ধরনের অবমূল্যায়নের ফলে সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েছেন বিদেশগামী শিক্ষার্থীরা। অতিরিক্ত দামে কিনতে হচ্ছে ডলার। এছাড়াও বাজারে ডলারের কৃত্রিম সংকটের কারণে ভুগতে হচ্ছে তাদের। গত বৃহস্পতিবার দিলকুশায় ডলার কিনতে আসা নজরুল ইসলাম নামে এক শিক্ষার্থী বলেন, রোববার ফ্লাইট কিন্তু এখন খোলাবাজারে ডলার নেই বলে জানান বিক্রেতারা। যদিও বেশি দামে কেউ কেউ দিতে পারবে বলে জানিয়েছেন। অন্যদিকে বিলাসী পণ্যেও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব রয়েছে। গাড়িসহ বিভিন্ন বিলাসী পণ্যের আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় দেশের বাজারেও এসব পণ্যের দাম বেড়ে যাবে। দাম বাড়বে প্রসাধনী ও কসমেটিকের।
এছাড়াও ইলেক্ট্রিক ও ইলেক্ট্রনিক্সসহ আমদানিনির্ভর অন্যান্য পণ্যের ওপরও ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়বে। বাড়বে এসব পণ্যের বাজারমূল্য। ফলে চাপে পড়তে হবে ভোক্তাদের। সবমিলিয়ে দেশের বাজারে প্রায় সব পণ্যেরই দাম বাড়ার সম্ভাবনা রয়েছে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে। তবে বাজার স্থিতিশীল রাখতে কার্যকর পদক্ষেপই বড় ধরনের ভোগান্তি থেকে বাঁচাতে পারে।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি আইএমএফ’র পরামর্শে বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নির্ধারণে ক্রলিং পেগ পদ্ধতি অনুসরণ করেছে। এক প্রজ্ঞাপনে নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানটি প্রতি মার্কিন ডলারের বিনিময় হার স্থানীয় মুদ্রা টাকায় ৭ টাকা বৃদ্ধি করে। যে পদ্ধতি অনুসরণের অনেক আগ থেকেই পরামর্শ দিয়ে আসছিল অর্থনীতিবিদরা। অবশেষে বাংলাদেশ ব্যাংকের এ নীতি সাময়িক অসুবিধা হলেও দীর্ঘমেয়াদি দেশের অর্থনীতির জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে বলে মনে করেন তারা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ড. মুহাম্মদ শাহাদাত হোসেন সিদ্দিকী বলেন, ডলারের মূল্য বৃদ্ধির ভবিষ্যৎ প্রভাব নিয়ে আমাদের স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি চিন্তা করতে হবে। তাহলে দেখা যাবে আমাদের আমদানি খরচ বাড়বে সবকিছুৃতে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে। এসব খাতে দেখা যাবে ৭ থেকে ৮ শতাংশ খরচ বেড়ে গেছে। কারণ এর কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্যসহ সবকিছুর দাম বাড়বে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দাম বাড়লে দেশে উৎপাদিত সবকিছুতে চাপ পড়বে।
তিনি বলেন, বর্তমান ধারায় আমাদের মূল্যস্ফীতি কমছে না। এরই মধ্যে ডলারের দাম বাড়ায় দীর্ঘমেয়াদি একটা প্রভাব পড়বে। প্রসেসড গুডসসহ সবকিছুতে মূল্য বৃদ্ধি পাবে। যে সমস্ত কাঁচামাল ও মধ্যবর্তী পণ্য আমদানি করা হবে সেগুলোতো রাতারাতি উৎপাদিত পণ্য হয়ে যাবে না। যখন উৎপাদিত পণ্য হবে তখন মূল্যস্ফীতির প্রভাব এর ওপরও পড়বে। এসব পণ্যের দেশীয় দাম বেড়ে যাওয়া মানে হচ্ছে রপ্তানিমূল্যও বেড়ে যাওয়া। অন্য দেশ থেকে সস্তা বলে বিদেশিরা এখন বাংলাদেশ থেকে পোশাক কেনে। কিন্তু ডলারের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় ভবিষ্যতে কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি পেলে পোশাকের দাম বেড়ে যাবে। এজন্য প্রভাব পড়বে রপ্তানিতে।
ড. শাহাদাত বলেন, অর্থনীতির থিওরি অনুযায়ী টাকার অবমূল্যায়নের পর রেমিট্যান্স বেশি আসার কথা। কিন্তু দেখা গেছে যত চেষ্টাই করা হচ্ছে না কেন রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়ছে না। এর পেছনে কারণ কী? এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ফরেন এক্সচেঞ্জ রেট নিয়ে একটা দেশ যখন আতঙ্কে থাকে তখন ফরমাল চ্যানেলগুলোতে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসার কথা তা আসে না। এ শঙ্কা থেকে বের হওয়া জরুরি। তাই ফরেন এক্সচেঞ্জ মার্কেটের স্থিতিশীলতার জন্য ব্যালেন্স করতে হবে। এক্সপোর্ট- ইমপোর্টসহ আমাদের ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকাউন্টেরও ব্যালেন্স করতে হবে- যেটা সবচেয়ে জরুরি।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here