ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ১৪২৩ জন নিহত হওয়ার প্রাথমিক হিসাব করেছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন; এই হিসাবে আহতের সংখ্যা ২২ হাজারের বেশি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের স্বাস্থ্যবিষয়ক কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সদস্য সচিব ও সমন্বয়ক তারেকুল ইসলাম এই হিসাব দিয়েছেন। তবে তিনি বলেছেন, এই হিসাবও চূড়ান্ত নয়।
এই গণঅভ্যুত্থানে নিহত ও আহতদের তালিকা প্রণয়নে তারেকুলসহ ২১ সদস্যের একটি দল কাজ করছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কারের দাবিতে গত জুলাইয়ের শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন শুরুর পর তা সহিংসতায় গড়ায় দুই সপ্তাহ পর।
১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের পিটুনির শিকার হয় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা। পরদিন তার প্রতিক্রিয়ায় বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ হলে সেখানে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ সমর্থকরা হামলা চালালে ছয়জন নিহত হয়।
এরপর আন্দোলন যেমন তীব্র হয়, সরকারের দমন-পীড়নও বাড়ে। কয়েকশ মানুষ নিহত হওয়ার পর আন্দোলনের তোড়ে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে।
সেপ্টেম্বরের শুরুতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ৬ শতাধিক নিহত হওয়ার একটি প্রাথমিক হিসাব দিয়েছিল। তবে আহত অনেকে পরে মারা যায়, আবার অনেক মৃত্যুর তথ্যও সেখানে ছিল না।
শুক্রবার রাতে ফেইসবুকে হতাহতের প্রাথমিক তালিকা এবং তাদের পরিবারকে সহযোগিতার বিষয়গুলো তুলে ধরেন তারেকুল।
তিনি বলেন, “আমরা ১৪২৩ জন শহীদের একটি প্রাথমিক তালিকা তৈরি করতে পেরেছি। তবে এর মধ্যে সংযোজন-বিয়োজন হবে। আমরা ভেরিফিকেশেন এবং ভেলিডেশনের কাজটি চলমান রেখেছি। আমরা একটি সঠিক তালিকা প্রকাশ করতে সক্ষম হব।”
আন্দোলনে বিজয়ের পর গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটিও একটি তালিকা করছে। তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন।
জাতীয় নাগরিক কমিটির স্বাস্থ্য টিমের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করার কথা জানিয়ে তরিকুল বলেন, “আমরা এরই মধ্যে তাদের সাথে কিছু কাজ করছি। সামনে এটা অফিসিয়ালি একটা টিম করেও করার ভাবনা আমাদের মধ্যে আছে।”
তারেকুলের ফেইসবুক পোস্টে বলা হয়, এই আন্দোলনে ২২ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৫৮৭ জনের অঙ্গহানি হয়েছে। গুলি লেগে আংশিক বা সম্পূর্ণ দৃষ্টিশক্তি হারিয়েছে ৬৮৫ জন। ৯২ জনের দুই চোখই গুলি লেগে নষ্ট হয়ে গেছে।
তিনি বলেন, “আহতদের তালিকা তৈরির কাজটি বেশ চ্যালেঞ্জিং ছিল। কারণ এই সংখ্যাটা বিপুল। এরমধ্যে আমরা যখন হাসপাতাল থেকে তথ্য সংগ্রহ করি, তখন প্রচুর গার্বেজ ডাটা চলে আসে। যারা আন্দোলনে আহত না, তাদের নাম চলে আসে। আহতদের শুধু নাম পাওয়া যায়, মোবাইল নম্বর, ঠিকানা পর্যন্ত পাওয়া যায় না।”
আহতদের সংখ্যাও হালনাগাদ হবে বলে জানান তারেকুল।
আন্দোলনে হতাহতদের তালিকা তৈরি করতে গত ১৫ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। এর স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের সাবেক জ্যেষ্ঠ সচিব মুহাম্মদ হুমায়ুন কবির এই কমিটির প্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন।
সহায়তা
তারেকুল জানান, এ পর্যন্ত ৬০০ জনের বেশি আহতকে তাদের পক্ষ থেকে জরুরি সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আস সুন্নাহ ফাউন্ডেশন ২ হাজার, সাজেদা ফাউন্ডেশন ৪৫০ জন রোগীর সার্বিক দায়িত্ব নিয়েছে, ১৮০০ জনকে আর্থিক সহায়তা দিয়েছে।
তিনি বলেন, “চিকিৎসার ব্যবস্থা আগেই ফ্রি করা হয়েছে। কিন্তু এটাই যথেষ্ট না, অনেকের পরিবার টিকতে পারছে না। খাওয়ার টাকা নাই। আমরা যখনই এমন খবর পাচ্ছি, সেখানেই বিভিন্ন ডোনার এজেন্সির মাধ্যমে আমরা সাহায্য পাঠানোর চেষ্টা করছি।”
জুলাই শহীদ ফাউন্ডেশনের পক্ষ থেকে হাসপাতালে ভর্তি, যাদের অঙ্গহানি হয়েছে, চোখের দৃষ্টি হারিয়েছে, গুলি লেগেছে- এমন রোগীদের কাছে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে আর্থিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার কথা জানান তারেকুল।
তিনি বলেন, “আর্থিক সহায়তার এই বিষয়টি একেবারেই প্রাথমিক, চূড়ান্ত না। কারণ সরকার এবং ফাউন্ডেশন আলাদা। সরকার আহতদের সহায়তায় একটি নীতিমালা করছে, সেখানে প্রত্যেক শহীদ পরিবারকে ৮ লাখ টাকা, আহতদের ৪ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সরকারের বাইরে জুলাই ফাউন্ডেশন সব সময় চালু থাকবে। সেখান থেকে সহায়তা দেওয়া হবে।”
আন্দোলনের সময় অনেকেই নিহত হয়েছেন, কিন্তু তাদের পরিবার মৃত্যু সনদ সংগ্রহ করতে পারেননি।
তারেকুল বলেন, “এ বিষয়ে আমরা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলেছি। এ রকমের ঘটনা অনেকের সাথে ঘটেছে। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় দ্রুত একটি দিকনির্দেশনা দিবেন, সে অনুযায়ী তাদের ডেথ সার্টিফিকেটের ব্যবস্থা করা হবে।”
এর আগে ৯ সেপ্টেম্বর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে অন্তত ৬৩১ জন নিহত হয়েছেন ও আহত হয়েছেন ১৯ হাজার ২০০ জনের বেশি বলে দাবি করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাদের ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম বা এমআইএস শাখা থেকে প্রস্তুত খসড়া প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
সোমবার (৯ সেপ্টেম্বর) এমআইএস শাখার পরিচালক অধ্যাপক ডা. মিজানুর রহমান এ কথা জানান। তিনি বলেন, সারাদেশের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল থেকে তথ্য নিয়ে এ তালিকা করা হয়েছে। এর একটি অনুলিপি মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ তালিকা নিয়মিত হালনাগাদ করা হচ্ছে। তবে এ ব্যাপারে তিনি বিস্তারিত তথ্য দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন।
সূত্র জানায়, ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত হতাহতের তথ্য এই তালিকায় রয়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী ঢাকা বিভাগে সবচেয়ে বেশি নিহত ও আহত হয়েছেন। এই বিভাগে ৪৭৭ জন নিহত এবং আহত হয়েছেন ১১ হাজার। সারাদেশে আহত হয়ে যারা হাসপাতালে গেছেন, তাদের ৩ হাজার ৪৮ জনের অবস্থা ছিল গুরুতর। তাদের অস্ত্রোপচারের প্রয়োজন হয়। কমপক্ষে ৫৩৫ জন স্থায়ীভাবে অক্ষম হয়ে পড়েছেন। নিহতদের মধ্যে অন্তত ৪৫০ জনকে হাসপাতালে আনা হয় মৃত অবস্থায়। বাকি ১৮১ জন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা গেছেন।
আন্দোলনে হতাহতের তালিকা করতে গত ১৫ আগস্ট স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সাবেক সিনিয়র সচিব মুহাম্মদ হুমায়ুন কবির এ কমিটির প্রধান। এই কমিটির তত্ত্বাবধানে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখা তালিকাটি তৈরি করে। মুহাম্মদ হুমায়ুন কবির বলেন, হতাহতের তালিকা তৈরি এবং তাদের পরিবারকে সরকারি সহায়তা দেওয়ার জন্য নীতিমালা করার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাদের। তালিকার কাজ এখনও চলছে। তিনি বলেন, আন্দোলনের সময় মামলার ভয়সহ নানা কারণে নিহত অনেককে হাসপাতালে আনা হয়নি। এ কারণে নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
হতাহতের তথ্য চেয়ে ভিসি-ডিসি এসপিদের চিঠি
আন্দোলনে নিহত ও আহতদের তথ্য এবং মামলার তথ্য চেয়ে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি, সব জেলা প্রশাসক, এসপি, সিভিল সার্জন ও সরকারি হাসপাতালে চিঠি দিচ্ছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা। গতকাল সোমবার ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের এ তথ্য জানান। এ ছাড়া সব গণমাধ্যমের কাছে জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের ফুটেজ চেয়ে অনুরোধপত্র পাঠানো হয়েছে। পাশাপাশি দেশের বড় কবরস্থানগুলোর তত্ত্বাবধায়কদের কাছেও চিঠি পাঠানো হয়েছে। কবরস্থানে পরিচয় আছে এবং বেওয়ারিশ হিসাবে কতজনকে দাফন করা হয়েছে– এ তথ্য চাওয়া হয়েছে। গণহত্যার তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহযোগিতা করতে সংশ্লিষ্ট সবার প্রতি আহ্বান জানান চিফ প্রসিকিউটর।
তিনি বলেন, আন্দোলনের সমন্বয়কদের সঙ্গে তারা মতবিনিময় করবেন।
আসামি গ্রেপ্তারের বিষয়ে তিনি বলেন, এসব অপরাধের মাত্রা এতটাই ভয়াবহ যে, তদন্তকালে আসামিদের গ্রেপ্তার করার প্রয়োজন হবে।