বিনামূল্যে জীবনধারনের সুযোগসহ শিক্ষা ও কোরআনের আলো ছড়িয়ে দিচ্ছে কোনাপাড়া আদর্শবাগ এলাকার আলী মোহাম্মদ খান রোডে অবস্থিত মদিনাতুল উলূম দৃষ্টি প্রতিব›দ্ধী এতিমখানা মাদ্রাসা। রাজধানীর বৃহত্তর ডেমরা ও যাত্রাবাড়ী থানা এলাকায় ৯ বছর ধরে একের পর এক কোরআনের পাখি আকাশে উড়িয়ে দিচ্ছে প্রতিষ্ঠানটি। তবে দু:খ জনক বিষয় হলো—আজও এ প্রতিষ্ঠান পরিচালিত হচ্ছে ব্যক্তি উদ্যোগে ভাড়ায় চালিত ফ্ল্যাটে। নেই কোন উল্লেখযোগ্য সরকারি—বেসরকারি সহায়তা। এক্ষেত্রে মানবসেবায় ব্রত এ মাদ্রাসাটি ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগীতা পেলে ডেমরা—যাত্রাবাড়ী থানা এলাকাসহ দেশের সর্বস্তরের এতিম ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য নতুন এক দুয়ার খুলে দিতে সক্ষম বলে জানিয়েছেন কর্তৃপক্ষরা।
এদিকে আর্থিক অনটন নিয়ে এখনো মাদ্রাসাটি এতিম ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের জন্য বিনামূল্যে থাকা, খাওয়া এবং প্রকৃত শিক্ষার ব্যবস্থা করে যাচ্ছে বলে ইতোমধ্যে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছে। মানবতার সেবায় নিবেদিত এই মাদ্রাসা অসহায় শিশুদের জীবন পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। এখানে কেবল ধর্মীয় শিক্ষাই নয়, বরং আধুনিক সু—শিক্ষায় শিক্ষিত করে শিশুদের একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। এতে করে শিক্ষার্থীরা সমাজে সম্মানিত ও আত্মনির্ভরশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে উঠতে ব্যাপক সহায়তা পাচ্ছে এ মাদ্রাসা থেকে।
জানা যায়, মদিনাতুল উলূম দৃষ্টি প্রতিব›দ্ধী এতিমখানা মাদ্রাসাটি বিগত ২০১৬ সালে ব্যক্তি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে শিশুদের শিক্ষা প্রদান করে আসছে। প্রথমে কিছুসংখ্যক শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে মাদ্রাসায় ১৩৫ জন শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। তাদের মধ্যে ১৯ জন এতিম ও ৪৭ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী, এবং ৬৯ জন শিক্ষার্থী আছে যাদের কারো বাবা অথবা মা নেই।
আরও জানা যায়, অত্র মাদ্রাসার ছাত্র মো. নাজমুস সাকিব ২০২২ সালে সৌদি আরবে অন্ধদের কোরআন প্রতিযোগিতায় তৃতীয় স্থান অর্জন করে বাংলাদেশের জন্য অল্লাহ প্রদত্ত ভিন্ন এক রহমতের গৌরব বহন করেছে। এর পরের বছর ২০২৩ সালে এ মাদ্রাসারই মো. মাহিম বাংলাদেশে অন্ধদের কোরআন প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থান অর্জন করে প্রতিষ্ঠানের নাম আলোকিত করেছে। চলতি বছরে ছাত্র নাজমুস সাকিব ও মো. সাফিউল ইসলাম আবারও সৌদি আরবের অন্ধদের কোরআন প্রতিযোগিতার জন্য নির্বাচিত হয়েছেন যা দেশের জন্য আরেকটি বড় সম্মান বয়ে আনবে বলে প্রত্যাশা। প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজীনয় সহযোগীতা পেলে এ প্রতিষ্ঠান থেকেই পর্যায়ক্রমে বিশ^সেরা কোরআনের পাখি পৃথিবীর আকাশে উড়ে বেড়াবে বলে দাবি মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষরা দৈনিক জনকন্ঠকে বলেন, সমাজের অবহেলিত ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশুরা কারও সহায়তা ছাড়াই আল্লাহর অশেষ রহমতে পৃথিবীতে বেড়ে উঠছে, তাই বলে আমরা তাদের ছেড়ে দিতে পারি না। আমরা চাই, তারা যেন প্রকৃত শিক্ষা, উদারতা ও নৈতিকতাসহ কোরআনের আলোয় আলোকিত হয়ে সমাজের মূল্যবান সম্পদ হিসেবে গড়ে ওঠে। এখানে কেবল ইসলামিক শিক্ষাই নয়, বরং আধুনিক শিক্ষার ব্যবস্থাও রয়েছে যা ক্রমাগত সর্বাধুনিক হচ্ছে। ভবিষ্যতে মাদ্রাসাটি আরও বেশি এতিম ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের আশ্রয় দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। পাশাপাশি তাদের জন্য আধুনিক শিক্ষার সুযোগ তৈরীতে সম্প্রসারণের কাজ নিরলসভাবে এগিয়ে চলেছে।
এ বিষয়ে মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান শিক্ষক হাফেজ মাওলানা আবুল কালাম আজাদ দৈনিক জনকন্ঠকে বলেন, আমাদের নিজেদের খুব বেশি কিছু নেই, কিন্তু আমরা বিশ্বাস করি, আল্লাহর পথে কাজ করতে পারলেই আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি। প্রতিটি শিশুকে আমি নিজের সন্তান হিসেবেই দেখি। তাদের জন্য নিরাপদ আশ্রয়ে বিনামূল্যে থাকা, খাওয়া ও পড়াশোনাসহ পরিবারিক পরিবেশ তৈরি করেছি মাদ্রাসায়। অত্যন্ত স্নেহের সাথে লালন—পালন করে বড় করছি শিক্ষার্থীদের। মহান অল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য আমার লক্ষ্য একটাই, এই শিশুরা যেন প্রকৃত শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত না হয়।
তিনি আরও বলেন, শিক্ষার্থীদের জন্য আরও অনেক কিছু করার ইচ্ছে আছে। আমি বিশ্বাস করি, আল্লাহ আমার সহযোগী হবেন। আমি চাই এই শিশুরা যেন ভালো মানুষ হয়ে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। তারা যেন কখনো নিজেদের অনাথ বা বঞ্চিত মনে না করে।
মাদ্রাসার শিক্ষকগণ দৈনিক জনকন্ঠকে বলেন, শিশুদের জন্য কোরআন শিক্ষার পাশাপাশি গণিত, বিজ্ঞান এবং ভাষা শিক্ষার ব্যবস্থা আছে এখানে। সেইসাথে দক্ষ শিক্ষকদের তত্ত্বাবধানে তারা মুখস্থ কোরআন তেলাওয়াতের কৌশলও শিখছে। তাছাড়া দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের ব্রেইল পদ্ধতিতে কোরআন শিখানো হচ্ছে, যা তাদের কোরআনের পবিত্র বাণী উপলব্ধি করতে সহায়তা করছে। মাদ্রাসাটি তাদের ব্যক্তিগত উন্নয়ন ও মানসিক বিকাশের দিকেও সমানভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে।
মাদ্রাসার জন্মান্ধ শিক্ষার্থী নাজমুস সাকিব বলেন, আমি কখনো ভাবিনি যে আমি কোরআন শিখতে পারবো। কিন্তু এই মাদ্রাসায় এসে আমি ব্রেইল কোরআন শিখেছি, যা আমার জন্য একটি বড় পাওয়া। এছাড়া শিক্ষকদের স্নেহ এবং শিক্ষা পদ্ধতি আমাকে আশার আলো দেখাচ্ছে। আমি বিশ^সেরা কোরআনের পাখি হতে চাই মহান আল্লাহর রহমতে।
মাদ্রাসার এক এতিম শিক্ষার্থী মো. আব্দুর রহমান বলেন, আমি জন্মের পরে আমার পিতা—মাতাকে দেখিনি। বড় হুজুর আমাকে পিতৃস্নেহে বড় করে তুলছেন। আমাকে নিরাপদ আশ্রয় ও খাবারের ব্যবস্থাসহ লেখাপড়া করাচ্ছেন। এখানে নিয়মিত পড়াশোনা, ধর্মীয় শিক্ষা ও অন্যান্য নৈতিক শিক্ষার মাধ্যমে নিজের ভবিষ্যৎ গড়ার সুযোগ পাচ্ছি।
উল্লেখ্য: এলাকাবাসীরা এই মাদ্রাসার উদ্যোগকে অত্যন্ত প্রশংসনীয় বলে মনে করছেন। তাদের অভিমত, এই মাদ্রাসাটি কেবল কোরআন শিক্ষার প্রতিষ্ঠান নয়, এটি সমাজের অসহায় শিশুদের জন্য এক নতুন আশার আলো। এতিম ও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য বিনামূল্যে শিক্ষা প্রদানের এই উদ্যোগটি সারা দেশে মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে পারে, যেখানে শিক্ষা প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার।