শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রাথমিক ফলে ৪২ শতাংশ ভোট পেয়ে এগিয়ে আছেন দেশটির মার্ক্সবাদী নেতা অনুরা কুমারা দিসানায়েকে। গণ বিক্ষোভের মুখে রাজাপাকসে সরকারের পতনের পর মার্ক্সবাদী দিসানায়েকের মাধ্যমে জনতা পেতে চায় নতুন দিশা।
শ্রীলঙ্কার নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুসারে, দেশটির বৈধ ১ কোটি ৭০ লাখ ভোটারের মধ্যে প্রায় ৭৫ শতাংশ ভোট দিয়েছেন। এর আগে ২০১৯ সালের নির্বাচনে রেকর্ড ৮৩ দশমিক ৭২ শতাংশ ভোট পড়েছিল।
দেশটিতে গণ বিক্ষোভের মুখে রাজাপাকসে সরকারের পতনের পর এবারই প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হচ্ছে। এতে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট রনিল বিক্রমাসিংহে, সাবেক প্রেসিডেন্ট রানাসিংহে প্রেমাদাসার ছেলে সাজিথ প্রেমাদাসা ও ন্যাশনাল পিপলস পাওয়ার (এনপিপি) জোটের অনুরা কুমারা দিসানায়েকে।
এই তিন প্রার্থীর মধ্যে ৫৫ বছর বয়সী অনুরা কুমারা দিসানায়েকে দেশটির বামপন্থী জনতা বিমুক্তি পেরেমুনা (জেভিপি) পার্টির নেতা। দলটি কখনও শ্রীলঙ্কার কোনও সরকারের সঙ্গে জোটে ছিল না। এমনটি যে জোট থেকে দিসানায়েকে নির্বাচন করছেন, সেই জোটও তেমন কোনও আলোচনায় ছিল না বহুদিন। শ্রীলঙ্কার ২২৫ আসনের পার্লামেন্টে এই জোটের হাতে আছে মাত্র তিনটি আসন।
তবুও কেন এই জোট এবার নির্বাচনে ভালো করেছে, এর পেছনের কারিগর হলেন দিসানায়েকে।
২০২২ সালের ১৩ই জুলাই আন্দোলনের মুখে শ্রীলঙ্কায় রাজাপাকসে সরকারের পতন হয়। দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। দেশটির অর্থনীতি ভেঙে পড়ে। সেসময় রাজনৈতিক অস্থিরতার পরিস্থিতি দিসানায়েককে সামনে নিয়ে আসে। কারণ ক্ষমতাসীন রাজাপাকসে পরিবারকে উৎখাতে গণঅভ্যুত্থান গড়ে তুলতে তখন সক্রিয় ছিল দিসানায়েকের নেতৃত্বাধীন জেভিপি।
গণঅভ্যুত্থানের সময় ও পরে দিসানায়েকে হয়ে ওঠেন জনগণের আস্থার জায়গা। রাজাপাকসে পরিবারের পলায়নের পর রাজনীতিতে যে শূন্যতা তৈরি হয়, সেখানে বড় পরিবর্তনের ডাক দেন তিনি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার তো তিনি আগে থেকেই ছিলেন, সঙ্গে যুক্ত করেন ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার দাবি।
দিসানায়েকে সম্পর্কে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক গামিনি বিয়ানগোডা আল জাজিরাকে বলেন, “ব্যবস্থা পাল্টাতে তাকে আমার আন্তরিক মনে হয়েছে। দুর্নীতির দরজা তিনি সত্যিকার অর্থেই বন্ধ করে দিতে চান বলে আমার মনে হয়েছে।
“দিসানায়েকে শেষ পর্যন্ত দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে পারবেন কি না, তা অন্য আলোচনা। তবে তার মধ্যে আমি যে আন্তরিকতা দেখেছি, তা অন্য কোনও নেতার মধ্যে দেখিনি।”
কে এই অনুরা কুমারা দিসানায়েকে
রাজধানী কলম্বো থেকে ১৭৭ কিলোমিটার দূরে থামবুত্তেগামা গ্রামে এক মধ্যবিত্ত পরিবারে ১৯৬৮ সালে জন্ম দিসানায়েকের। দিনমজুর বাবা ও গৃহিনী মা তাদের সন্তানকে পড়ালেখা করাতে কার্পন্য করেননি। ছেলেকে থামবুথেগামা যামিনি মহাবিদ্যালয় ও থামবুথেগামা সেন্ট্রাল কলেজে পড়ান।
শ্রীলঙ্কার কেলানিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞানে স্নাতক করেন তিনি। স্কুলে পড়ার সময়ই বাম রাজনীতির সঙ্গে পরিচয়, যুক্ত হন জেভিপিতে। ১৯৮৭ ও ১৯৮৯ সালে সরকারবিরোধী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তখন জেআর জয়বর্ধনে ও আর প্রোমাদাসার সরকারকে সাম্রাজ্যবাদী ও পুঁজিবাদী আখ্যা দিয়ে এর বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনও করে জেভিপি।
ব্যাপক মাত্রায় রাষ্ট্রীয় দমন পীড়নের শিকার হয় তখন জেভিপি। সারাদেশে ৬০ হাজারের বেশি মানুষকে হত্যা করা হয়। এরমধ্যে জেভিপির প্রতিষ্ঠাতা রোহানা বিজেবীরাও ছিলেন।
দিসানায়েকে ১৯৯৫ সালে প্রথমবারের মতো সোস্যালিস্ট স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশনের জাতীয় মুখপাত্র হওয়ার পাশাপাশি জেভিপির কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটিতে যুক্ত হন। এরপর ২০০০ সালে প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন তিনি। পান কৃষি, গবাদি পশু, ভূমি ও সেচ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব।
২০১৪ সালে জেভিপির নেতা হওয়ার পর বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে দিসানায়েকে দলের অতীত অর্থাৎ ‘বিপ্লবকালে’ সংঘটিত অপরাধের জন্য ক্ষমা চান।
তার এই ক্ষমা চাওয়ায় দলের কয়েকজন সদস্য ও শ্রীলঙ্কার বামপন্থী মহলের একাংশের তোপের মুখে পড়েন দিসানায়েকে। এরপর থেকে দলের অতীত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বক্তব্য দেওয়ার সময় তাকে কৌশলী হতে দেখা যায়। বিপ্লবের সময়কার ঘটনা নিয়ে তাকে বেশ কয়েকবার দুঃখপ্রকাশ করতে দেখা গেছে, তবে কখনোই ক্ষমা চাননি।
বিপ্লবের সময় শ্রীলঙ্কার বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, অবসর নেওয়া পুলিশ-সেনাবাহিনীর সদস্য, শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা জেভিপির নির্মমতার শিকার হয়েছিল। দীর্ঘদিন তারা সাধারণ জনগণের কাছে আতঙ্কের অপর নাম ছিল।
জনমানস থেকে সত্তর ও আশির দশকের সেই স্মৃতি দূর করতে দিসানায়েকে দলের দায়িত্ব গ্রহণের পর পদক্ষেপ নেন।
একসময় যারা জেভিপির লক্ষ্যবস্তু ছিল সেই বুদ্ধিজীবী, শিল্পী থেকে শুরু করে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতা, বিরোধী মতাবলম্বীদের মধ্যে গত কয়েক বছরে সেতুবন্ধন নির্মাণে সক্ষম হন দিসানায়েকে। বিশেষ করে তার দুর্নীতি দমন অঙ্গীকারের মতো লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতি শ্রীলঙ্কানদের মন জয় করে।
যা স্পষ্ট হয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও লেখক গামিনি বিয়ানগোডার কথাতেই। তিনি বলেন, “১৯৮৯-৯০ সালে জেভিপি কী করেছিল, তার জন্য তাদের কড়া ভাষায় সমালোচনা করা আমি ঠিক মনে করি না। আজ আমরা যে জেভিপিকে দেখছি, তা আশির দশকের জেভিপি থেকে অনেক আলাদা।”
শ্রীলঙ্কার ঐতিহ্যবাহী নেতাদের মতো দিসানায়েকে কোনও ধনী ও ক্ষমতাধর পরিবার থেকে উঠে আসেননি। আর এজন্যই মূলত খুব সহজে জনগণের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়ে ওঠেন তিনি।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে, ন্যায়বিচার ও অর্থনৈতিক সংস্কারের মতো ইস্যুতে বক্তব্য দিয়ে তিনি মানুষের কাছে যান। অন্য দলগুলো যেখানে সমস্যার সমাধানে কার্যকরী কোনও পরিকল্পনা জনগণের সামনে আনতে পারেনি, সেখানে দিসানায়েকে একাধিক বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা তুলে ধরেন।
তবে দিসানায়েকের আমলে শ্রীলঙ্কায় বিদ্রোহ ও সহিংসতা বাড়তে পারে বলে মনে করছেন অনেকে। দেশটির রাজনৈতিক বিশ্লেষক কুশল পেরেরার মতো অনেকেই বলছেন, তিনি প্রকাশ্যে কখনও জাতিগত চরমপন্থার নিন্দা করেননি।
প্রতিবেশি দেশ ভারতের সঙ্গে দিসানায়েকে কেমন সম্পর্ক গড়বেন, এনিয়ে অনেকের মনে প্রশ্নও রয়েছে। কারণ তার দল জেভিপি ঐহিত্যগতভাবেই চীনঘেষা। অবশ্য দিসানায়েকের এনপিপি জোটের সবাই যে চীনঘেষা তা নয়।
এনপিপি জোটের জ্যেষ্ঠ নেতা অধ্যাপক অনিল জয়ন্ত সম্প্রতি দ্য উইককে বলেন, “আমাদের দল ভারতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে চায়। ভারত অবশ্যই আমাদের প্রতিবেশী ও পরাশক্তি। সম্প্রতি একটি শীর্ষ কৃষি সম্মেলনের জন্য ভারত আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছে। আমরা দিল্লি ও কেরালা সফর করেছি। আমাদের নেতা শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সব বড় শক্তির সঙ্গে বসতে চান।”