জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে নির্বাহী আদেশের দিকেই যাচ্ছে সরকার। বুধবারের (৩১ জুলাই) মধ্যে সরকারের এ সিদ্ধান্ত আসছে বলে জানিয়েছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হন।
সরকার আদালতের মাধ্যমে জামায়াতকে নিষিদ্ধের চিন্তা করলেও শেষ পর্যন্ত নির্বাহী আদেশেই তা কার্যকর হতে যাচ্ছে। নিষিদ্ধের আদেশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ থেকে জারি হবে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
মঙ্গলবার (২৯ জুলাই) বিকালে গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ১৪ দলীয় জোটের সভায় জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত হয়।
এর আগে ২০১৩ সালে এক রিটের পর জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল ও অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন হাইকোর্ট। ওই রায়ের পাঁচ বছর পর ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর নির্বাচন কমিশন দলটির নিবন্ধন বাতিল করে প্রজ্ঞাপন জারি করে।
ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ ১৯৭২-এর আওতায় রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছিল। ২০০৮ সালের ৪ নভেম্বর দলটিকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। তাদের নিবন্ধন নম্বর ছিল ১৪।
২০০৯ সালে হাইকোর্টে দায়ের করা ৬৩০ নম্বর রিট পিটিশনের রায়ে আদালত জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করায় গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০-এইচ ধারা অনুযায়ী ২০১৮ সালে অক্টোবরে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল করা হয়।
এদিকে নিবন্ধন বাতিলে হাইকোর্ট বিভাগের রায়ের বিরুদ্ধে জামায়াত আপিল করলে গত বছর (২০২৩) ১৯ নভেম্বর আপিল বিভাগ তা খারিজ করে দেন।
আদালতের রায়ের ফলে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন না থাকলেও রাজনৈতিক দল হিসেবে তারা নিষিদ্ধ ছিল না। দেশের প্রচলিত আইন ও সংবিধান অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধন না থাকলে কোনও দল নির্বাচনে অংশ নিতে পারে না। তবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড করতে পারবে না এমন কোনও বিধান নেই।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সরকারের চিন্তা ছিল— আদালতের মাধ্যমে দলটির বিচার করে তাদের কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা। এর বাইরে সংসদে আইন করে দলটিকে নিষিদ্ধ করার বিকল্প চিন্তাও ছিল ক্ষমতাসীন দলের।
আগে-পরে বিভিন্ন সময়ে জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠলেও ২০১৩ সালে শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে দলটিকে নিষিদ্ধের জোরালো দাবি ওঠে। পরে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল সংগঠন হিসেবে জামায়াতকে ‘যুদ্ধাপরাধ সংঘটনে সম্পৃক্ত’ বলে রায় দিলে দাবিটি আরও জোরালো হয়। এর প্রেক্ষাপটে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যক্তির পাশাপাশি সংগঠনকে বিচারের আওতায় আনতে আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন সংশোধনের উদ্যোগের কথাও বলা হয়েছিল।
সংগঠন হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগ এনে তদন্ত সংস্থার পক্ষ থেকে ২০১৪ সালের মার্চ মাসে ট্রাইব্যুনালে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলির কাছে প্রতিবেদনও জমা দেওয়া হয়।
শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের দাবির পর ২০১৩ সালে তৎকালীন আইন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার জন্য জাতীয় সংসদে শিগগিরই সিদ্ধান্ত হতে পারে। তিনি আরও বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার জন্য দুই-তিনটি উপায় আছে। এর মধ্যে যে কোনোটি প্রয়োগ করা যেতে পারে।
জামায়াতকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি আদালতের মাধ্যমে হতে পারে উল্লেখ করে তিনি জানিয়েছিলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দুটি রায়ে জামায়াতের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলা হয়েছে। সুতরাং, জামায়াতের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালও ব্যবস্থা নিতে পারে। সব কয়টি বিকল্প বিবেচনায় দলটির ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলে তিনি ওই সময় জানান।
২০১৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ হবে কিনা সেটি জানতে আদালতের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তখন তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন, রায় শিগগিরই হবে। তিনি ওই সময় আরও বলেন, তাদের নিষিদ্ধ করার জন্য ইতোমধ্যে কোর্টে একটি মামলা রয়ে গেছে। সেই মামলার রায়টা যতক্ষণ পর্যন্ত না হবে, সেখানে বোধহয় আমরা কোনও কিছু করতে পারি না।
তবে প্রধানমন্ত্রী কোন মামলার কথা উল্লেখ করেছিলেন সেটি তিনি পরিষ্কার করে বলেননি। প্রকৃতপক্ষে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার জন্য আলাদা কোনও মামলা হয়নি। জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলের আবেদন হলেও তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধ চেয়ে আদালতে কোনও মামলার তথ্য পাওয়া যায়নি।
তবে নিবন্ধন নিয়ে চলমান মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত দলটির মিছিল-সমাবেশসহ সব ধরনের রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের ওপর নিষেধাজ্ঞা চেয়ে ২০২৩ সালের ২৬ জুন আপিল আদালতে আবেদন করা হয়েছিল। ওই বছর ১৯ নভেম্বর জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে দেওয়া হাইকোর্টের রায় আপিল বিভাগ বহাল রাখার কারণে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের আবেদনটি আর আপিল বিভাগ গ্রহণ করেননি।
এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের পরদিন এক সংবাদ সম্মেলনে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করা হবে কিনা, সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, আদালত একে জঙ্গিবাদী সংগঠন হিসেবে রায় দিয়েছেন। তাদের নিষিদ্ধ করার ব্যাপারে একটি রিটও আছে। এই রিটের সমাধান না হওয়া পর্যন্ত আমরা এ ব্যাপারে কোনও মন্তব্য করতে পারি না।
এর বাইরে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছিলেন, ইতোমধ্যে তারা এ সংক্রান্ত আইনের খসড়া তৈরি করেছেন এবং তা মন্ত্রিপরিষদে অনুমোদনের জন্য পেশ করা হবে। আইনমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, যে আইন আছে তাতে জামায়াতে ইসলামীর বিচার করা যায় না এবং এ জন্য আইনটি সংশোধন করা হবে।
এরপর ২০২৩ সালের ১১ জুন আনিসুল হক ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে আয়োজিত ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধী হিসেবে বিচার করার জন্য যে আইন সংশোধন করার কথা আমি আগে বলেছি, সে প্রক্রিয়া কিন্তু চলমান। সংশোধনের জন্য আইনটি কেবিনেটে কিছু দিনের মধ্যে যাবে। তবে শেষ পর্যন্ত ওই আইন আর সংশোধন করা হয়নি।
সোমবার (২৯ জুলাই) ১৪ দলের বৈঠকে জামায়াত ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্তের পরদিন মঙ্গলবার (৩০ জুলাই) আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন আগামীকালের (বুধবার) মধ্যে একটা ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য। কোন আইনি প্রক্রিয়ায় হবে সেটা আমরা যখন সিদ্ধান্ত নেবো, তখন বলবো। যদি এই দলটিকে নিষিদ্ধ করা হয়, তাহলে দেশের আইনশৃঙ্খলা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির উন্নতি হবে।’
সরকার হয়তো নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করবে এমনটা উল্লেখ করে মন্ত্রী বলেন, ‘যখন (কোনও দল) নিষিদ্ধ হয় তখন নির্বাহী আদেশে হয়, বিচার বিভাগীয় আদেশে হয় না।’
একই দিন এক সংবাদ সম্মেলনে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ করার বিষয়ে ১৪ দল যে কথা বলছে, সেটি বাস্তবায়ন করবে সরকার। বাস্তবায়নের প্রক্রিয়া কী হবে, তার আইনগত দিক দেখেশুনে সরকার শিগগির পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে। আমরা আইনগত দিকটি ভালোভাবে দেখে নিতে চাই, যাতে কোনও ফাঁকফোকর দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে এই অপশক্তি আর কোনও সুযোগ না পায়।’
জামায়াত ইসলামীকে নিষিদ্ধের আদেশটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে হবে কিনা, জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘হয়তো স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই হবে। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা সেটাই।’
বুধবার আদেশ জারি হচ্ছে বিষয়টি নিশ্চিত করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেছেন, ‘অবশ্যই এ আদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেই হবে।’