কোটা বিরোধী আন্দোলন চলাকালে মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া মেট্রোরেল স্টেশনে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল দুর্বৃত্তরা। এ কারণে স্টেশন দু’টি সচল করতে দীর্ঘ সময় অপেক্ষা করতে হবে যাত্রীদের। গতকাল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষতিগ্রস্ত স্টেশন পরিদর্শন করে ক্ষয়ক্ষতির বিষয় অবহিত হন। মিরপুর-১০ নম্বর স্টেশনে ভাঙচুরের চিত্র দেখে অনেকটা বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন প্রধানমন্ত্রী। উপস্থিত সংবাদকর্মীদের সঙ্গে কথা বলার সময়ও আবেগাপ্লুত হতে দেখা যায় তাকে।
প্রধানমন্ত্রী সারা দেশে সরকারি প্রতিষ্ঠানে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনায় দেশবাসীর কাছে বিচার চেয়ে বলেন, দেশের জনগণকে তাদের বিচার করতে হবে। আমি জনগণের কাছে ন্যায়বিচার চাইছি। ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা দেয়ার মতো আমার আর কোনো ভাষা নেই।
শেখ হাসিনা বলেন, এই মেট্রোরেল করার সময়ও অনেক বাধা-বিঘ্ন আমাদের অতিক্রম করতে হয়েছিল। সব বাধা-বিঘ্ন অতিক্রম করে মেট্রোরেল আমরা করে দিয়েছি এবং সময়ের আগেই আমরা করতে পেরেছি। আজ মেট্রোরেল বন্ধ- কারণ, এই স্টেশন যেভাবে ধ্বংস হয়েছে যেটা সম্পূর্ণ ডিজিটাল ও ইলেকট্রনিক সিস্টেম, সম্পূর্ণ মডার্ন। এটা কতোদিনে ঠিক হবে আমি জানি না। কষ্ট পাবে কিন্তু মানুষ।
সরকার প্রধান বলেন, এটা সরকার করে দিয়েছে সকলে যাতে সময়মতো স্কুল-কলেজ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা নিজ নিজ কর্মস্থলে যেতে পারেন এবং কর্মস্থল থেকে আবার ঘরে ফিরে অন্তত কিছুটা সময় পরিবারের সঙ্গে কাটাতে পারেন। আর্থিক দিকটাও সাশ্রয় হয়। সেসব কথা চিন্তা করেই সরকার দেশের মানুষের কল্যাণে মেট্রোরেলসহ বিভিন্ন যোগাযোগের মাধ্যম নির্মাণ করে দিয়েছে। অবকাঠামোর উন্নয়ন ঘটিয়েছে। প্রধানমন্ত্রী মেট্রোরেল ক্ষতিগ্রস্ত করার প্রসঙ্গ টেনে বলেন, এতে আপনারাই কষ্ট পাবেন। দেশের মানুষই কষ্ট পাবে। এই ঢাকা শহরের মানুষই কষ্ট পাবে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা আবার ট্রাফিক জ্যামে পড়ে থাকতে হবে। কর্মস্থলে সময়মতো পৌঁছানো আবার ফেরত আসায় দীর্ঘ সময় লাগবে, বসে বসে সেই ট্রাফিক জ্যামে কষ্ট পাওয়া থেকে আপনাদের এই কষ্ট লাঘব করতে চেয়েছিলাম। তিনি বলেন, তাই আমি আপনাদেরকেই বলবো- যে কষ্ট আমি লাঘব করতে চেয়েছি সেই কষ্ট আবার যারা সৃষ্টি করলো তাদের বিরুদ্ধে আপনাদেরই রুখে দাঁড়াতে হবে। দেশবাসীকেই রুখে দাঁড়াতে হবে। এর বিচার তাদের করতে হবে। আমি তাদের কাছেই বিচার চাই। এর আগে তিনি ক্ষতিগ্রস্ত মেট্রোরেল স্টেশন পরিদর্শন করেন। তিনি পুরো স্টেশন ঘুরে ঘুরে দেখেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন চলার সময় দুর্বৃত্তরা শুক্রবার তাণ্ডবলীলা চালায় মেট্রোরেল স্টেশনে। ভাঙচুর করা হয় সিসি ক্যামেরা, এলইডি মনিটর, টিকিট কাটার মেশিনসহ বিভিন্ন জায়গায়। লুট করা হয় মূল্যবান অনেক জিনিস।
শেখ হাসিনা বলেন, যেসব স্থাপনা মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করে- বেছে বেছে সেগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। যারা উন্নয়নবিরোধী এসব কর্মকাণ্ডে জড়িত- তাদের মানসিকতা কোন ধরনের সে প্রশ্নও তোলেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই বাংলাদেশ আজ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে। আজকে বাংলাদেশের উন্নয়ন দৃশ্যমান। বাংলাদেশ আজ বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। যারা আজ বিদেশে যাচ্ছে, তারা সেই সম্মান পাচ্ছে। আগে সেটা পেতো না। ভিক্ষুকের জাতি হিসেবে আমাদের একটা বঞ্চনার স্বীকার হতে হয়েছে। আজকে সেটা ছিল না। কিন্তু আমি জানি না এই যে প্রতিটি স্থাপনা তৈরি করেছি যেগুলো মানুষকে সেবা দেয়, তাদের জীবনযাত্রা সহজ করেছে। মানুষের জীবনকে উন্নত করেছে ঠিক সেগুলো ভেঙে সম্পূর্ণ নষ্ট করে দেয়া কী ধরনের মানসিকতা। সরকার প্রধান বলেন, এই মেট্রোরেলে চড়ে উত্তরা থেকে মতিঝিল পর্যন্ত নির্বিঘ্নে মানুষ যাতায়াত করছে। এই মেট্রোরেলের ওপর কেন এত আক্রমণ? এটাই আমার প্রশ্ন। এই মেট্রোরেল এবং এর স্টেশনগুলো যে আমরা তৈরি করেছি এর সার্ভিসসহ সবকিছুই ছিল আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন। অন্যান্য বহু দেশের তুলনায় একটি আধুনিক দৃশ্যমান সুন্দর একটা মেট্রোরেল আমরা করেছিলাম। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ধ্বংসের চিহ্ন দেখলাম এটা বিশ্বাস হতে চায় না যে, এদেশের মানুষ এটা করতে পারে। কিন্তু, সেই কাজই করেছে। আর আমার দুঃখ লাগে ২০১৮ সালে যখন ছাত্ররা কোটা বিরোধী আন্দোলন করলো আমি সঙ্গে সঙ্গে সেটা মেনে নিয়ে কোটা বাতিল করে দিলাম। এর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার থেকে মামলা করা হলো সরকারের জারি করা পরিপত্র হাইকোর্টে বাতিল হলো। সেটার বিরুদ্ধে সরকার আপিল করলো। সেই সময়ে হাইকোর্টের রায়কে স্থিতাবস্থা দিয়ে তারা একটা সময় (সুপ্রিম কোর্ট) দিলেন। এই সময়ের মধ্যে সকলের বক্তব্য শুনে তারা একটা সিদ্ধান্ত দেবেন।
তিনি বলেন, আমি কোটা আন্দোলনকারী থেকে শুরু করে দেশবাসীকে বললাম- একটু ধৈর্য ধারণ করতে হবে। এটা তো সরকার আপিল করেছে, তাদের হতাশ হতে হবে না। সেই আশ্বাস দিয়ে তাদের বললাম বিরত থাকতে। একটু তো ধৈর্য ধরতে হবে। যেকোনো নাগরিককেই তো আইন- আদালত মেনে চলতে হবে। আর এই সুযোগ নিয়ে সেই ১৭ই জুলাই থেকে যেভাবে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ শুরু হলো। তিনি বলেন, ’৭৫-এর পর ২৯টি বছর এদেশের মানুষ বঞ্চিত ছিল। সেখান থেকে আওয়ামী লীগ সরকারে এসে জনগণের খাদ্য নিরাপত্তা, বিদ্যুৎ, চিকিৎসাসেবা জনগণের দোরগোড়ায় পৌঁছে দেয়া, রাস্তাঘাট, পুল-ব্রিজসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণে গত ১৫ বছরে মানুষের জীবনযাত্রায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। তিনি প্রশ্ন করেন এগুলো কাদের জন্য? এই মেট্রোরেলে কি আমি চড়বো? আমাদের সরকার ও মন্ত্রীরা শুধু চড়বে না- জনগণ চড়বে, এটা আমার প্রশ্ন। এর উপকারিতা আপনারা পাচ্ছেন। এদেশের সাধারণ জনগণ পাচ্ছেন। তাহলে এটার ওপর এত ক্ষোভ কেন? আমরা বার বার অনুরোধ সত্ত্বেও আন্দোলন, কোটা বিরোধী আন্দোলন। আদালতের রায় নিয়েও আমরা বারবার কথা বলেছি, বোঝাতে চেষ্টা করেছি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকে মন্ত্রণালয়ের যারা এবং এই মেট্রোরেল নির্মাণ কাজের সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকেরই চোখে পানি পড়ছে। এটা দেখে যে কীভাবে এই দানবীয় কর্মকাণ্ড হলো, আর কীভাবে করলো? শেখ হাসিনা বলেন, আমি তো দেশের মানুষের জীবনমান উন্নত করতেই কাজ করে যাচ্ছি এবং করেছিও। যা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের কী অবস্থা ছিল? আর আজকে বাংলাদেশ উন্নয়নের উচ্চধাপে উঠে গেছে। সেখান থেকে নামাতে হবে কেন? আমার প্রশ্ন সেটাই। বাকরুদ্ধ কণ্ঠে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দিন-রাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। এই অ্যালাইনমেন্টে (মেট্রোরেলের) আমি পরিবর্তন এমনভাবে করে দিয়েছি যাতে দ্রুত সময়ে হয়। তিনি এটাকে আরও বাড়িয়ে একেবারে মতিঝিল ও কমলাপুর রেলস্টেশন পর্যন্ত করে দিয়েছেন। যাতে মানুষ আরও সুন্দরভাবে চলতে পারে। যারা এর ওপর আঘাত করলো এই মেট্রোরেল এভাবে ভাঙচুর করলো, যেখানে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ চলাচল করতে পারতো অল্প সময়ের মধ্যে। এদেশের মানুষ কতো খুশি ছিল। এই আনন্দ যারা নষ্ট করলো, জনগণের নির্বিঘ্নে চলাচলের পথ যারা রুদ্ধ করলো তাদের বিচার এদেশের জনগণকেই করতে হবে। আমি সেই বিচারের দিকে চেয়ে আছি। আমি এর নিন্দা জানানোর ভাষা পাচ্ছি না।
স্টেশন পরিদর্শনের সময় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব তোফাজ্জল হোসেন মিয়া, ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম ও ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ এন সিদ্দিক উপস্থিত ছিলেন।