আল্লাহতায়ালার দেওয়া ফরজ হুকুমগুলো প্রত্যেক মুসলমানের জন্য পালন করা বাধতামূলক। কেউ তা আদায় করে ভালোবাসা থেকে, কেউ আদায় করে আল্লাহর শাস্তির ভয়ে। ফরজ আমল যতো ভালোবাসা থেকে হবে- ততই নফলের প্রতি উৎসাহ বাড়বে।
ফরজের পাশাপাশি নফলের প্রতি উৎসাহ দিয়ে হাদিসে কুদসিতে ইরশাদ হয়েছে, ‘ফরজ আমলের বাইরে যদি বান্দা কোনো কিছুর বিনিময়ে আমার নৈকট্য অর্জন করতে চায়, তা আমার নিকট ফরজ আমল আদায়ের তুলনায় অধিক পছন্দনীয়। বান্দা নফলের মাধ্যমে আমার নৈকট্য চাইতে থাকলে সে আমার ভালোবাসা পায়। আর যখন আমি কাউকে ভালোবাসি আমি তার শ্রবণশক্তি হয়ে যাই, যা দ্বারা সে শোনে। আমি তার দৃষ্টিশক্তি হয়ে যাই, যা দ্বারা সে দেখে। তার হাত হয়ে যাই, যা দ্বারা সে স্পর্শ করে। তার পা হয়ে যাই, যা দ্বারা সে হাঁটে। যদি সে আমার কাছে কোনো কিছু চায়, আমি তাকে তা দিয়ে দেই আর কোনো কিছু থেকে আশ্রয় চাইলে আমি তাকে আশ্রয় দেই।’ –সহিহ বোখারি: ৬৫০২
ফরজ আমলের বাইরে এই নফল আদায় করতে যেয়ে অনেক সময় দ্বিধা তৈরি হয়। কখনো অধিকহারে নামাজের দিকে মন ঝুঁকে, কখনো কোরআন তেলাওয়াত, কখনোবা জিকির। কোনোটাতেই পুরো স্থির হওয়া হয় না। অথচ হাদিসের নির্দেশনা সার্বক্ষণিক আমল।
হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আল্লাহতায়ালার কাছে অধিক পছন্দনীয় হলো- ওই আমল যা সব সময় করা হয়। যদিও তা অল্প হোক।’ -সহিহ বোখারি: ৬৪৬৫
কোন আমলকে স্থায়ী করবো- এ ভাবনার সময় অনেক আমল সামনে আসে। কারণ অসংখ্য হাদিসে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন- রোজার কথা, কোথাও বলেছেন দিনের শুরুভাগে নামাজের কথা। আবার কাউকে বলেছেন- শুধু ফরজকে আঁকড়ে ধরতে। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো ছিলেন রূহানি চিকিৎসক। প্রশ্নকারী ব্যক্তির অন্তরের অবস্থা বুঝে একেকজনকে একেক আমলের কথা বলেছেন।
আমরা যেহেতু নিজেদের রোগ সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নই, তাই সব নির্দেশনা সামনে রেখে নির্দিষ্ট একটিকে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরা দুষ্কর হয়ে পড়ে। শুরু হয় মনস্তাত্বিক যুদ্ধ। এক আমল করতে গেলে মনে হয়, ওই আমলের ফজিলত ছুটে গেলো। সব আমলের ফজিলত নিতে গিয়ে দেখা যায়, কোনোটাই নিয়মিত হয়ে উঠছে না৷ হাদিস অধ্যয়নে বুঝা যায়, শুধু আমরাই এমন দ্বিধান্বিত হই না, এ অবস্থায় পড়তেন সাহাবায়ে কেরামও। হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লামও এ সমস্যার সমাধান দিয়েছেন বেশ সুন্দরভাবে। বলে দিয়েছেন, কোন আমলকে সার্বক্ষণিক সঙ্গী করা উচিত।
মুসনাদে আহমাদে রয়েছে, হজরত আবদুল্লাহ ইবনে বিশর (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- এক ব্যক্তি হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দরবারে এসে আবেদন জানালো, ‘ইয়া রাসূলাল্লাহ! আমাদের কাছে শরিয়তের হুকুমগুলো (ফরজের বাইরে) অনেক বেশি মনে হচ্ছে। আমাদেরকে এমন এক বিষয়ের কথা বলুন, যা দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরবো।’ তিনি বললেন, ‘সব সময় তোমার জবানকে আল্লাহর জিকিরে সিক্ত রাখবে।’
এমন অর্থবোধক আরও অনেক হাদিস কিতাবাদিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে। যেগুলোতে হজরত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম স্থায়ী আমল হিসেবে জিকিরের পরামর্শ দিয়েছেন। একটু গভীরভাবে লক্ষ্য করলে এর মর্ম বুঝতে পেরে বিস্মিত হতে হয়!
‘আল্লাহ’ শুধু এই শব্দ এক জিকির। ‘সুবহানাল্লাহ’ এক জিকির। ‘আস্তাগফিরুল্লাহ’ জিকিরের পাশাপাশি এক দোয়া। সারাদিন অনবরত যখন তার নাম জবানে জারি থাকবে, সে জবান অনিচ্ছায়ও অন্যায় বলা থেকে বিরত থাকবে। আপনি সারাদিন যার নাম নেবেন, নিঃসন্দেহে তার ভালোবাসাও পেয়ে যাবেন। আর সমস্ত আমলের লক্ষ্য তো এটাই, আল্লাহর ভালোবাসা।
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহতায়ালার কাছে অধিক পছন্দনীয় আমল হলো- জিকির। আর এই শ্রেষ্ঠ আমলকে আল্লাহতায়ালা সবচেয়ে সহজ করে দিয়েছেন। এ আমল চলাফেরায়, উঠাবসায়, অজু অবস্থায় কিংবা অজুহীন অবস্থায়- সর্বদাই জিকির করা সম্ভব। আল্লাহতায়ালার রহমত ও অনুগ্রহ দেখুন। অধিক পছন্দনীয় আমল অধিক সহজ।
জিকির যতো বেশি হবে, আল্লাহতায়ালার ভালোবাসাও অন্তরে বৃদ্ধি পাবে। হজরত যূন-নূন (রহ.) বলেন, ‘যে তার জবান ও কলবকে আল্লাহর স্মরণে নিমগ্ন রাখবে, আল্লাহ তার অন্তরে ভালোবাসার প্রদীপ জ্বালিয়ে দেবেন।’ তিনি কত সুন্দরই না বলেছেন, ‘দুনিয়া শান্তিময় নয় তার জিকিরবিহীন, আখেরাত শান্তিময় নয় তার ক্ষমাবিহীন আর জান্নাত শান্তিময় নয় তার দর্শনবিহীন।’
স্পষ্ট হয়ে গেলো, সার্বক্ষণিক আমল হিসেবে জিকির অত্যন্ত সহজ এবং অধিক মর্যাদাপূর্ণ আমল। একে মজবুতভাবে আঁকড়ে ধরার পাশাপাশি যদি অন্য আমল অনিয়মিত হয়, তবুও তা হবে অধিক ফলপ্রসূ।