সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম আনার হত্যার ঘটনায় আওয়ামী লীগের একের পর এক নেতা গ্রেপ্তার হচ্ছেন। এবার আনার হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের মধ্যে ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর নাম উঠে এসেছে। তাকে আটক করেছে পুলিশ
মঙ্গলবার (১১ জুন) বিকেল ৪টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডি এলাকা থেকে তাকে আটক করে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের একটি দল। এর আগে ৬ জুন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক কাজী কামাল আহম্মেদ বাবু ওরফে গ্যাস বাবুকে আটক করেছে জেলা গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)।
আওয়ামী লীগ নেতা কাজী কামাল বাবুর বরাত দিয়ে ডিবির একটি সূত্র জানিয়েছে, আনার হত্যার মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম মিন্টুর যোগাযোগ ছিল।কলকাতার ফ্ল্যাটে খুন করার পর এমপি আনারের মরদেহের ছবি তোলেন খুনিচক্র। সে ছবি কাজী কামাল আহমেদ ওরফে গ্যাস বাবুর হোয়াটসঅ্যাপে পাঠিয়েছিলেন হত্যা মামলার আসামি শিমুল ভুঁইয়া ওরফে শিহাব ওরফে ফজল মোহাম্মদ ভুঁইয়া ওরফে আমানুল্যাহ সাঈদ। ছবি পাওয়ার পর শিমুল ভূঁইয়াকে ধন্যবাদ জানান গ্যাস বাবু। মূলত, হত্যাকাণ্ডের মাস্টারমাইন্ড আক্তারুজ্জামান শাহীনের হয়ে কাজ করেন স্থানীয় আওয়ামী লীগের এ নেতা।
তদন্ত কর্মকর্তারা আরও বলেন, এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনায় শুধু গ্যাস বাবুই নয়, আড়াল থেকে আখতারুজ্জামান শাহীনের সঙ্গে শামিল হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের আরও অনেকেই। পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেছেন একাধিক নেতা। সরাসরি হত্যাকাণ্ডে বা পরিকল্পনায় না জড়ালেও পেছন থেকে ইন্ধন দেন অনেকে। অনেকে আবার খুনের পর দেন বাহবাও। শিমুল ভূঁইয়ার সাভারের বাসা থেকে সদ্য উদ্ধারকৃত মোবাইলগুলো ঘেঁটে এমন অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য পেতে সক্ষম হয়েছে ডিবি।
পুলিশ বলছে, যেসব নেতা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে এ হত্যাকাণ্ডের আগে ও পরে জড়িত তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে। আর তদন্ত সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল একটি সূত্রের দাবি, সরকারের সবুজ সংকেত মিললেই সন্দেহের তালিকায় থাকা এসব আওয়ামী লীগ নেতাকে একে একে আটকানো হবে গোয়েন্দাদের জালে।
কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেন থেকে খুনের এক সপ্তাহ আগে ৬ মে কেন হত্যা মিশনের প্রধান দুই সদস্য মিন্টুকে ফোন করলেন? যাদের সঙ্গে মিন্টুর এ কথোপকথন হয়েছে, তারা হলেন– মূল পরিকল্পনাকারী যুক্তরাষ্ট্রে পালানো আক্তারুজ্জামান শাহীন ও তাঁর বেয়াই চরমপন্থি নেতা শিমুল ভূঁইয়া ওরফে আমানুল্লাহ। দু’পক্ষের মধ্যে আলাপ হয় টাকার অঙ্ক নিয়ে। দেশে ফিরে ওই বিষয়ে জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল গিয়াস আহমেদ বাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করতে শাহীন ও শিমুলকে নির্দেশ দেন মিন্টু। অনেক দিন ধরে বাবু এলাকায় মিন্টুর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত। গতকাল বুধবার তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক দায়িত্বশীল সূত্র থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
মঙ্গলবার ধানমন্ডির একটি এলাকা থেকে মিন্টুকে আটক করে ডিবি। এর পর তাঁকে ডিএমপির গোয়েন্দা কার্যালয় মিন্টো রোডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। সেখানে পুলিশ হেফাজতে আগে থেকেই রয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের আরেক নেতা বাবু। গতকাল পর্যন্ত মিন্টুকে আটকের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে পুলিশের পক্ষ থেকে স্বীকার করা হয়নি। তবে একটি সূত্র বলছে, বাবুর মুখোমুখি করেও মিন্টুকে কিছু প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছেন গোয়েন্দারা।
গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেছেন, সংসদ সদস্য আজীম হত্যার তদন্ত বাধাগ্রস্ত করতে তদবির বা কোনো চাপ নেই। সঠিক পথেই তদন্ত এগোচ্ছে। কে চাপ দেবে? তদন্তে যা বেরিয়ে আসবে, সেভাবেই বিচার প্রক্রিয়া এগিয়ে যাবে।
যেসব প্রশ্নে চুপ
তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দু’জন কর্মকর্তা সমকালকে জানিয়েছেন, আজীম হত্যায় জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মিন্টুর জড়িত থাকার বিষয়টি প্রথমে সামনে আসে শিমুল ভূঁইয়াকে জিজ্ঞাসাবাদে। শিমুল ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিতে তাঁর নাম বলেছেন। এ ছাড়া বাবুর নামও ফাঁস করেন শিমুল। এর পর গোয়েন্দারা খুঁজতে থাকেন– কেন, কীভাবে, কী কারণে এ হত্যাকাণ্ডে মিন্টুর নাম সামনে আসছে। এর উত্তর মেলাতে গিয়ে গোয়েন্দাদের তদন্তে সন্দেহভাজন কিছু বিষয় ঘুরপাক খায়। আজীম হত্যার বিষয়টি জানাজানি হওয়ার আগে কেন বাবুর ফোন থেকে ছবি দেখে তা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন মিন্টু। নিজ জেলার একজন সংসদ সদস্যকে হত্যা করার মতো লোমহর্ষক ঘটনার ক্লু পেয়েও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানাননি তিনি। ওই সময় আজীমের পরিবারের সদস্যরা নানা জায়গায় তাঁকে খোঁজাখুঁজি করেছিলেন। যখন অনেকেই জানতেন আজীম হয়তো ‘নিখোঁজ’, তখন মিন্টু নিশ্চিত হয়ে যান আজীমকে হত্যা করা হয়েছে। কলকাতা থেকে লাশ উদ্ধারের আগেই কেন হঠাৎ বাবুর তিনটি ফোনসেট গায়েব! এ ঘটনায় থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন তিনি। পরে এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসাবাদ করা হলে বাবু দাবি করেন, তাঁর ব্যবহৃত তিনটি ফোনসেট নিয়ে গেছেন মিন্টু। এসব নষ্ট করে ফেলা হতে পারে।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই ফোনে খুনের অনেক আলামত ছিল। সবকিছু সামনে আসার শঙ্কায় তিনটি ফোনসেট সরিয়ে ফেলা হয়। এ ব্যাপারে মিন্টুকে এখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। এ ছাড়া কেন খুনের এক সপ্তাহ আগে ৬ মে সঞ্জিভা গার্ডেনস থেকে মিন্টুকে ফোন করেন শাহীন ও শিমুল। গোয়েন্দা ভাষ্য, অগ্রিম ২০ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল। আর হত্যা মিশন সফল করতে টাকার অঙ্ক ছিল ২ কোটির বেশি। এমনকি হত্যা মিশন সফল করে ১৫ মে ঢাকায় আসেন শিমুল। এর পর টাকা পরিশোধের জন্য বাবুকে ফোন করেন। দিন-তারিখ ঠিক হওয়ার পরও শেষ পর্যন্ত টাকা পরিশোধ করেননি তিনি। আজীম হত্যার বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায় ২২ মে। এর পরই হত্যা মিশনের সদস্যরা একে একে গা-ঢাকা দেন। তবে ২০ মে দেশ ছাড়েন শাহীন। কারও কারও ভাষ্য, আজীম হত্যার তদন্তে যে প্রশ্ন সামনে আসছে, তার সদুত্তর দিতে না পারলে আজকালের মধ্যে মিন্টুকে এ মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হতে পারে। গোয়েন্দারা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করছেন, রাজনৈতিকভাবে লাভবান হতে এ হত্যার ছকে মিন্টু ছিলেন কিনা। কারণ সর্বশেষ জাতীয় নির্বাচনে ঝিনাইদহ-৪ আসন থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশী ছিলেন মিন্টু।
ডরিনের অভিযোগ
আজীমের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস ডরিন বলেছেন, ‘অপরাধীদের বাঁচাতে তদবির হচ্ছে। কোনো তদবিরের চাপে বাবা হত্যার বিচার যেন নষ্ট না হয়।’ গতকাল বুধবার সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বাবা হত্যার বিচার চেয়েছেন ডরিন। এর পর তিনি সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন।
ডরিন বলেন, ‘স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে বলেছি, আমার বাবাকে হত্যা করা হয়েছে, এ ঘটনার যেন সঠিক বিচার হয়। জড়িত সন্দেহে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অনেককে আটক করা হয়েছে। আমি শুনেছি, অপরাধীদের বাঁচাতে অনেক জায়গা থেকে তদবির হচ্ছে। তাদের যেন ছেড়ে দেওয়া না হয়।’
তিনি বলেন, ‘বাবু নামে যাঁকে আটক করা হয়েছে, তিনি বাবার প্রতিপক্ষ নন। আমাদের সঙ্গে তাঁর কোনো শত্রুতাও নেই। আমার মনে অনেক প্রশ্ন জাগছে। আমার কথা হলো, এ খুনে টাকার জোগানদাতা কে? আপনারা দেখেছেন, তাঁকে আটকের আগে থানায় তিনি জিডি করেছেন। তাঁর তিনটি ফোনসেট হারিয়েছে বলে দাবি করেন। একই দিনে একজন মানুষের তিনটি ফোন কীভাবে হারিয়ে যায়– সেটাও আমার প্রশ্ন।’ ডরিন বলেন, ‘মিন্টুকেও জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডিবি নিয়ে গেছে। অবশ্যই তাদের কাছে কোনো তথ্যপ্রমাণ আছে, সেটা আমি নিজেও জানি। আমি বিশ্বাস করি, অপরাধীকে তিল পরিমাণ ছাড় দেন না প্রধানমন্ত্রী।’
সদুত্তর না পেলে ব্যবস্থাগতকাল বিকেলে রাজধানীর মিন্টো রোডের নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার হারুন অর রশীদ বলেছেন, ডিবির কাছে হত্যার বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত আছে। এর ভিত্তিতে মিন্টু যদি সদুত্তর দিতে না পারেন, তাহলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, বাবুর কাছে পাওয়া তথ্য-উপাত্ত বিচার-বিশ্লেষণের পরই জিজ্ঞাসাবাদের জন্য মিন্টুকে ডাকা হয়েছে। মিন্টুর কাছে তথ্যগুলো জানতে চাওয়া হবে।
তিনি বলেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তার কাছে যদি মিন্টু সদুত্তর দিতে পারেন, তবে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আর যদি কোনো প্রশ্নের সদুত্তর দিতে না পারেন, তদন্তের ধারাবাহিকতায় যা করার তাই করা হবে।
জিজ্ঞাসাবাদে বাবু অকপটে শিকার করেন, শিমুল ভূঁইয়ার সঙ্গে তাঁর বৈঠক হয়েছিল। শিমুল ভূঁইয়া তাঁকে এমপি আজীমকে হত্যার পর ছবি দেখান।
হারুন বলেন, এমপি আজীম হত্যায় এ পর্যন্ত দুই রাজনীতিকের সম্পৃক্ততা পেয়েছি। বাবু রিমান্ডে রয়েছেন, মিন্টুর জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। এ ছাড়া অনেকের সম্পর্কে তথ্য-প্রমাণ রয়েছে। ধীরে এগোচ্ছি। কারও প্ররোচনায় কোনো নিরপরাধ ব্যক্তিকে হয়রানি করা হবে না।
কে এই মিন্টু
ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুতে ২০০৮ সালে উপজেলা নির্বাচন করে জামায়াত প্রার্থীর কাছে হেরেছিলেন সাইদুল করিম মিন্টু। ভোটে হারলেও ২০১১ সালে তাঁর ভাগ্যের দুয়ার খুলতে থাকে। ওই বছর ঝিনাইদহের পৌর মেয়র নির্বাচিত হন। এর পর আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। সীমানা নিয়ে আইনি জটিলতায় টানা ১১ বছর মেয়র ছিলেন তিনি। এ সময় জেলার রাজনীতির শীর্ষ পদে বসার পাশাপাশি পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে তাঁর সম্পদ। এলাকায় পরিচিতি পান ‘ফাটা কেষ্ট’ হিসেবে।
ঝিনাইদহের রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একাধিক নেতার ভাষ্য, কেন্দ্রীয় বেশ কয়েক নেতার সঙ্গে ‘ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক’ থাকায় দীর্ঘদিন স্থানীয় আওয়ামী লীগে একক আধিপত্য মিন্টুর। যাঁকে খুশি সংগঠনে পদ দেন, আবার খেয়ালখুশিমতো বাদও দেন। সংসদ সদস্য আজীম হত্যায় অভিযুক্ত কাজী কামাল গিয়াস আহমেদ বাবুকে এভাবেই জেলা আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে বসান। এখন রিমান্ডে থাকা বাবু তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে পরিচিত। ঝিনাইদহে ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগকেও কার্যত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন তিনি।
মিন্টু ঝিনাইদহ শহরের আরাপপুর ক্যাসল ব্রিজ-সংলগ্ন ইন্দিরা সড়কের বিলাসবহুল বাড়িতে স্ত্রী ও দুই ছেলে নিয়ে থাকেন। বর্তমানে তিনি ঝিনাইদহ চেম্বার অব কমার্স এবং দোকান মালিক সমিতির সভাপতিও।
ঝিনাইদহ আওয়ামী লীগের এক প্রবীণ নেতা বলেন, জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য আশরাফুল আলমের ভাই মোশাররফ হোসেনের সঙ্গে ১৯৭৩ সালে মাছ ধরতে গিয়ে জাসদ গণবাহিনীর হাতে খুন হয়েছিলেন মিন্টুর বাবা রুহুল কুদ্দুস। বাবা মারা যাওয়ার পর এলোমেলো হয়ে যায় তাঁর জীবন। পড়াশোনায় বেশি দূর এগোতে পারেননি। তাই হলফনামায় মিন্টু লেখেন ‘স্বশিক্ষিত’।
পরে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত হন। ১৯৮৩ সালে জেলা ছাত্রলীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। ১৯৮৪ সালে ভারমুক্ত হয়ে পূর্ণ সাধারণ সম্পাদক হন। ১৯৮৯ সালে জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। এর পর যুবলীগ না করে সরাসরি হয়ে যান স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা। কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন। এক পর্যায়ে জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদ পান। ১৯৯৯-২০০০ সালে জেলার সব সহযোগী সংগঠন নিয়ে শ্রমিক লীগ গঠনে উদ্যোগী হন। এর পর ২০১৫ সালে জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
২০০৮ সালের সংসদ নির্বাচনে জেলা আওয়ামী লীগের বর্তমান সভাপতি সফিকুল ইসলাম অপু ঝিনাইদহ-২ আসন থেকে নৌকা প্রতীকের প্রার্থী হিসেবে মনোনয়ন পান। নিজের পছন্দের প্রার্থী না হওয়ায় জেলা আওয়ামী লীগের দলীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেন মিন্টু। ২০১৪ সালেও ঝিনাইদহ-২ আসন থেকে মনোনয়ন পান অপু। অভিযোগ আছে, তাঁকে হারাতে নূরে আলম সিদ্দিকীর ছেলে তাহজীব আলম সিদ্দিকীকে সমর্থন দেন মিন্টু ও তাঁর সহযোগীরা।
মিন্টুর নামে বর্তমানে একাধিক মামলা রয়েছে। ১৯৯৮ সালে ছাত্রনেতা মোম হত্যাকাণ্ডের অন্যতম আসামি ছিলেন। এ ছাড়া ২০১৪ সালে শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল গফফার হত্যার ঘটনায় অন্যতম সন্দেহভাজন ছিলেন তিনি। গফফারের স্ত্রী বিভিন্ন সময় স্বামীর হত্যাকারী হিসেবে মিন্টুর নাম বলেছেন। এ ছাড়া পৌর মেয়র থাকাকালে অন্য কর্মকর্তার সঙ্গে মশক নিধন, গাড়ি মেরামত, রাস্তা পরিষ্কারসহ বিভিন্ন প্রকল্পের বিলের চেকে মূল টাকার সঙ্গে অতিরিক্ত সংখ্যা বসিয়ে জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। ৩৮ চেকের মাধ্যমে প্রায় ৭৪ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে দুদকের মামলায় মিন্টুসহ চারজনকে আসামি করা হয়। ওই মামলার এখন তদন্ত চলছে।
এলাকাবাসীর অভিযোগ, পৌরসভার প্রকল্প, দোকানপাট ইজারা, বিভিন্ন সালিশ বৈঠকের নামে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন মিন্টু। ঝিনাইদহ শহরের ক্যাসল ব্রিজ-সংলগ্ন এলাকায় তাঁর রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি। তাঁর বিরুদ্ধে রয়েছে জমি দখলের অভিযোগ। এ ছাড়া শহরে জেলা বিএনপির আগের অফিসের জায়গা কিনে সেখানে গড়ে তোলেন ছয় তলা মার্কেট। পৌর এলাকার মহিষাকুণ্ডুতে রয়েছে তাঁর বাগানবাড়ি। সদরের নারিকেলবাড়িয়া এলাকায়ও তাঁর রয়েছে অনেক সম্পদ। এ ছাড়া দেশের বাইরেও তাঁর ব্যবসা রয়েছে বলে এলাকায় চাউর আছে। বর্তমানে মিন্টু পরিবহন, ঠিকাদারিসহ নানা ধরনের ব্যবসা করছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক জেলা আওয়ামী লীগের এক শীর্ষ নেতা জানান, কৌশলে সব সময় সংগঠনের ভেতরে ‘দ্বন্দ্ব’ তৈরি করে রাখেন তিনি। তাঁর বিরুদ্ধে কমিটি বাণিজ্যের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য আজীমের বিপক্ষেও কাজ করেছিলেন। এমপি পদে মনোনয়ন ছাড়াও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক পদ নিয়ে আজীমের সঙ্গে দ্বন্দ্ব ছিল মিন্টুর। সর্বশেষ সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক হতে চেয়েছিলেন আজীম, কনক কান্তি দাস এবং মিন্টু। ভোটাভুটি ছাড়াই মিন্টুকে সাধারণ সম্পাদক ঘোষণা করা হয়। জেলা সম্মেলনের কয়েক মাস পর হঠাৎ কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের ১০ সদস্যের কমিটি ঘোষণা দেন মিন্টু। কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা ছিলেন মিন্টুর অনুসারী। এ নিয়ে নেতাকর্মীর মধ্যে ক্ষোভ দেখা দেয়।
গত ১২ মে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে যান এমপি আনোয়ারুল আজীম আনার। সেদিন সন্ধ্যা ৭টার দিকে কলকাতায় তার পারিবারিক বন্ধু গোপাল বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। পরদিন, ১৩ মে চিকিৎসক দেখাতে হবে জানিয়ে দুপুর ১টা ৪১ মিনিটে গোপালের বাড়ি থেকে বের হন আনার। সন্ধ্যায় ফিরবেন বলেও জানান তিনি। পরে বিধান পার্কের কাছে কলকাতা পাবলিক স্কুলের সামনে থেকে ট্যাক্সিতে উঠেছিলেন তিনি। চলে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় আনারের মোবাইল নম্বর থেকে তার বন্ধু গোপালের কাছে ম্যাসেজ আসে যে, তিনি দিল্লি যাচ্ছেন এবং সেখানে পৌঁছে তাকে ফোন করবেন।
পরে ১৫ মে হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো বার্তায় এমপি আনার বন্ধু গোপালকে জানান, তিনি দিল্লি পৌঁছেছেন এবং ভিআইপিদের সঙ্গে আছেন। তাকে ফোন করার দরকার নেই। একই বার্তা পাঠান বাংলাদেশে তার ব্যক্তিগত সহকারী রউফের কাছেও।
১৭ মে আনারের পরিবার তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে গোপালকে ফোন করেন। ওই সময় তারা গোপালকে জানান, তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছেন না তারা। পরিবারের পক্ষ থেকে ওই দিন ঢাকায় থানায় অভিযোগ করা হয়। এরপর থেকে আর এমপি আনারের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
২০ মে এমপি আনারের খোঁজ করতে গিয়ে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তার মোবাইল লোকেশন ট্র্যাক করে। তারা জানতে পারেন, কলকাতায় বন্ধুর বাড়ি থেকে বের হওয়ার পর তার মোবাইলের লোকেশন একবার পাওয়া গিয়েছিল সেখানকার নিউমার্কেট এলাকায়। এরপর ১৭ মে তার ফোন কিছুক্ষণের জন্য সচল ছিল বিহারে। পরে বুধবার (২২ মে) ভারতের এনডিটিভির খবরে বলা হয়, কলকাতার নিউ টাউনের সঞ্জিভা গার্ডেনসের একটি ফ্লাটে এমপি আনারকে খুন করা হয়েছে।