মানবতার ভয়াবহ বিপর্যয় সুদানে
এক অন্ধকার অধ্যায়ে ডুবে যাচ্ছে সুদান, চলছে হত্যাযজ্ঞ। সেখানে ৪৮ ঘণ্টায় হত্যা করা হয়েছে ২০০০ বেসামরিক নাগরিককে। শুধুমাত্র প্রসূতি হাসপাতালে ৪৬০ জনকে হত্যা করা হয়েছে। স্বামীদের বাধ্য করা হয়েছে স্ত্রীর ধর্ষণের শব্দ শুনতে। কার্যত দেশটিতে নরক নেমে এসেছে। জাতিসংঘ একে ‘অত্যাচারের যুদ্ধ’ হিসেবে বর্ণনা করেছে। দেশজুড়ে ১ লাখ ৫০ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন। পুরুষ ও শিশুদের বাধ্য করা হয়েছে তাদের স্ত্রী, মা ও কন্যাদের ওপর সংঘটিত ভয়াবহ ধর্ষণ প্রত্যক্ষ করতে। এ খবর দিয়েছে অনলাইন ডেইলি মেইল।উত্তর দারফুরের রাজধানী এল ফাশের সোমবার ১৮ মাসের অবরোধের পর র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস (আরএসএফ) নামে এক আধাসামরিক বাহিনীর হাতে পড়ে। এই বাহিনী নিজস্ব সমান্তরাল সরকার গঠনের চেষ্টা করছে। সুদানি সেনাবাহিনীর শেষ অবস্থানগুলো ধসে পড়েছে। সাহায্য সংস্থা ও চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, গণহত্যা, ঘরে ঘরে হত্যা ও রক্তে ভেসে থাকা রাস্তায় ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহের দৃশ্য সর্বত্র। স্যাটেলাইট ছবিতে দেখা গেছে গণকবর ও গণহত্যার চিহ্ন। বিশ্লেষকদের মতে- রক্তের দাগে ঢাকা মাটি। বেঁচে যাওয়া লোকজন জানিয়েছেন, শিশুদের বিছানায় গুলি করা হয়েছে, আর হাসপাতালের ওয়ার্ডে রোগীদের হত্যা করা হয়েছে। বুধবার জানা যায়, একটি প্রসূতি হাসপাতালে ৪৬০ জনের বেশি মানুষকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। সুদান নেটওয়ার্ক ডক্টরস এক বিবৃতিতে জানায়, র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সেস ঠাণ্ডা মাথায় সৌদি হাসপাতালের ভেতরে যাদের পেয়েছে সবাইকে হত্যা করেছে। নার্স নাওয়াল খলিল বলেন, ছয়জন আহত মানুষকে বিছানায় হত্যা করেছে আরএসএফ। তাদের মধ্যে নারীও ছিলেন। আমি পালিয়ে বাঁচি।সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলোতে দেখা গেছে, নিরস্ত্র মানুষদের এক সারিতে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হচ্ছে। কিছু ভিডিওতে আল-ফাতেহ আবদুল্লাহ ইদরিস নামে এক ব্যক্তি নিজেই মানুষ হত্যার ভিডিও করেছে। পরে দাবি করে, সে নিজেই হয়তো দুই হাজার মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী। দেশটির এই গৃহযুদ্ধে যৌন সহিংসতা ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে পড়েছে। নারী ও কিশোরীদের ধর্ষণ, যৌনদাসী হিসেবে ব্যবহার এবং জাতিগত পরিচয় বা আনুগত্যের কারণে ধর্ষণ- এসব এখন নিয়মিত ঘটনা।২০২৫ সালের এপ্রিল মাসে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশ করে ‘দে রেপড অল অব আস’ শিরোনামে এক তদন্ত প্রতিবেদন। সেখানে ২০২৩ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আরএসএফ সদস্যদের হাতে নারীদের দলবদ্ধ ধর্ষণের প্রমাণ পাওয়া যায়। ৩০ বছর বয়সী হামিদা বলেন, তারা আমার হাত বেঁধে তিনজন মিলে ধর্ষণ করে। এ সময় সে দৃশ্য দেখতে বাধ্য করা হয় আমার মেয়েকে। আমি হাসপাতালে যাইনি, কারণ কেউ যেন বিষয়টি না জানে। আমি ভেঙে পড়েছি। ছয় সন্তানের মা আমিনা বলেন, আমার ১১ বছর বয়সী ছেলে চিৎকার করছিল। বলছিল- আমার মাকে ছেড়ে দাও। ওরা আমার ছেলেকে বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারে। এতে তার মেরুদণ্ড ভেঙে যায়। ১৭ দিন পর সে মারা যায়। অবশেষে তিনি ধর্ষকের সন্তান জন্ম দেন। কোনো চিকিৎসা পাননি। হুসেইন নামের ৪২ বছর বয়সী এক ব্যক্তি জানান, ওরা আমার স্ত্রীকে আমার সামনে ধর্ষণ করে হত্যা করে। তারপর আমাকে প্রহার করে অচেতন করে ফেলে। ইউনিসেফের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে জানা যায়, এক বছর বয়সী শিশুদেরও ধর্ষণ করা হয়েছে। ২০২৫ সালের শুরুতে কমপক্ষে ২০০ শিশুর ধর্ষণের তথ্য পাওয়া যায়। এর মধ্যে ৪ জন এক বছরের শিশু এবং ১৬ জন পাঁচ বছরের নিচে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ধর্ষণ ছাড়াও আরএসএফ সদস্যরা নারীদের গরম তরল ঢেলে, ব্লেড দিয়ে কেটে নির্যাতন করেছে। এসব ঘটনার অপরাধী কখনও শাস্তি পায়নি।বিশ্লেষকরা নিশ্চিত করেছেন এ সপ্তাহে আরএসএফ দারফুরের এল-শাফির শহর দখল করেছে। এটি ছিল সেনাবাহিনীর শেষ ঘাঁটি। তা দখল করে নেয়া যুদ্ধের নতুন এক ভয়াবহ মোড়। জাতিসংঘ মাসের পর মাস হুঁশিয়ারি দিচ্ছিল। কিন্তু বিশ্ব উদাসীন। পাঁচ সন্তানের এক মা বললেন, ওরা আমার বাড়িতে ঢুকে আমার ১৬ বছরের ছেলেকে হত্যা করে। অন্যরা জানিয়েছেন, আরএসএফ সদস্যরা বন্দিদের শিরচ্ছেদ করার হুমকি দিচ্ছিল। বয়স্ক, গর্ভবতী নারী ও শিশুদের মাইলের পর মাইল হেঁটে টুয়িলার দিকে পালাতে হয়েছে। পথে মৃতদেহের সারি দেখা গেছে। হাজারের মধ্যে মাত্র কিছুজনই জীবিত পৌঁছেছেন।এক মানবাধিকার কর্মী বলেন, পুরুষরা পৌঁছাতে পারছেন না। হয় তারা নিহত, নিখোঁজ বা বন্দি।সুদানের অস্থিরতার ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৫৬ সালে স্বাধীনতার পর থেকে দেশটিতে ২০টি অভ্যুত্থান, তিনটি গৃহযুদ্ধ, প্রায় চার মিলিয়ন মৃত্যু হয়েছে। বর্তমান যুদ্ধ শুরু হয় ২০২৩ সালের এপ্রিল মাসে, যখন দুই সামরিক নেতা পরস্পরের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়। তাদের একজন আবদেল ফাত্তাহ আল-বুরহান। অপরজন মোহাম্মদ হামদান দাগালো (হেমেদতি)। আরএসএফ আসলে ২০০০ সালের গোড়ার জানজাউইদ মিলিশিয়া থেকে গড়ে উঠেছে। তারা দারফুরে জাতিগত নিধনের অভিযোগে অভিযুক্ত। ২০২৪ সালে হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ২১৮ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে বলা হয়, পশ্চিম দারফুরে জাতিগত নির্মূল, ধর্ষণ, গণহত্যা ও বাড়িঘর পুড়িয়ে ফেলার ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালের জুনে এল জেনিনায় ১৫,০০০ মানুষের মৃত্যু হয় বলে জাতিসংঘ জানায়।