জাকের আলির বিধ্বংসী ব্যাটিংয়ের পর বোলারদের আরেকটি দুর্দান্ত পারফরম্যান্সে স্মরণীয় সাফল্য পেল বাংলাদেশ। রেকর্ড-গড়া জয়ে উইন্ডিজকে হোয়াইটওয়াশ করে বছর শেষ করলো বাংলাদেশ। শেষ টি-টোয়েন্টিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৮০ রানে হারিয়ে তিন ম্যাচের সিরিজ ৩-০ ব্যবধানে জিতে নিল বাংলাদেশ। ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে এই সংস্করণে বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জয় এটি।
আইসিসি টি-টোয়েন্টি র্যাঙ্কিংয়ে চার নম্বর দল ওয়েস্ট ইন্ডিজ। দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন তারা। বলা হয় এই সংস্করণ তাদের জন্যই। বাংলাদেশ এখানে চরম অধারাবাহিক। র্যাঙ্কিংয়ে অবস্থান ৯ নম্বর। কিন্তু মাঠের বাইরের সব সমীকরণ বদলে গেল মাঠের ক্রিকেটে। সফরজুড়ে দুর্দান্ত পারফর্ম করা জাকের আলি জ্বলে উঠলেন শেষ ম্যাচেও। বোলিং গ্রুপ আরও একবার মেলে ধরল নিজেদের। সম্মিলিত পারফরম্যান্সে অভাবনীয় সাফল্যে বছর শেষ করল বাংলাদেশ।
তিন ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশ এর আগে হোয়াইটওয়াশ করতে পেরেছে গত বছর দেশের মাঠে ইংল্যান্ডকে ও ২০১২ সালে আয়ারল্যান্ডকে তাদের মাঠে। তবে এবার ওয়ানডে সিরিজে হোয়াইটওয়াশড হওয়ার পর এমন জয়, নিয়মিত অধিনয়ায়ক নাজমুল হোসেন শান্ত, গুরুত্বপূর্ণ দুই ক্রিকেটার তাওহিদ হৃদয় ও মুস্তাফিজুর রহমানকে ছাড়া এই জয় অনেক দিক থেকেই স্মরণীয়। অনেক হতাশার বছরের শেষটা বাংলাদেশ করল দারুণভাবে।
সেন্ট ভিনসেন্টে বাংলাদেশ সময় শুক্রবার ভোরে দলকে ভালো শুরু এনে দেন একাদশে ফেরা পারভেজ হোসেন ইমন। এরপর জাকের আলির বিধ্বংসী ইনিংসে বাংলাদেশ তোলে ২০ ওভারে ১৮৯ রান।
এই মাঠের সর্বোচ্চ স্কোর এটি। ক্যারিবিয়ানে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রানও।
রান তাড়ায় ক্যারিবিয়ানরা কোনো চ্যালেঞ্জই জানাতে পারেনি। তাদের ইনিংস শেষ ১০৯ রানেই।
ম্যাচের শুরুতে ছয় ছক্কায় ৪১ বলে ৭২ রানের অসাধারণ অপরাজিত ইনিংস উপহার দেন জাকের। এই সফরে টেস্ট সিরিজে তিনি দারুণ দুটি ইনিংস উপহার দিয়েছেন, ভালো খেলেছেন দুটি ওয়ানডেতেও। টি-টোয়েন্টির শেষটা করলেন নিজের ব্যাটিংয়ের উজ্জ্বলতম বিজ্ঞাপন মেলে ধরে। স্কিল, পেশির জোর আর ‘গেম সেন্স’ মিলিয়ে ক্যারিবিয়ানদের নিয়ে স্রেফ ছেলেখেলা করলেন যেন।
অথচ তার ইনিংসটি শেষ হতে পারত ১৭ রানে। পঞ্চদশ ওভারে শামীম হোসেনের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝিতে দুুজনই চলে যান এক প্রান্তে। রান আউট হয়েছেন ভেবে রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে মাঠ ছেড়ে যান জাকের। কিন্তু টিভি রিপ্লেতে দেখা যায়, আউট হয়েছেন আদতে শামীম। জাকেরকে আবার ডেকে পাঠান আম্পায়ার। ‘নতুন জীবন’ পেয়ে ক্যারিবিয়ানদের প্রাণ ওষ্ঠাগত করে ছাড়েন তিনি।
এরপর বাকি কাজ বোলারদের। এখানেও বছরজুড়ে দুর্দান্ত পারফর্ম করা রিশাদ হোসেন শেষটা করলেন দুর্দান্ত। ২১ রানে এই লেগ স্পিনারের প্রাপ্তি ৩ উইকেট, যেটি তার ক্যারিয়ার সেরা বোলিং। তাসকিন আহমেদ, শেখ মেহেদি হাসান, হাসান মাহমুদরা যথারীতি আলো ছড়ালেন আবার।
বাংলাদেশের দাপটের শুরু একদম ম্যাচের শুরু থেকেই। সৌম্য সরকারের চোটে সুযোগ পাওয়া পারভেজ হোসেন ইমন শুরু করেন প্রথম ওভারে দৃষ্টিনন্দন এক বাউন্ডারিতে। পরে দেখান তার হাতের জোরও।
আগের দুই ম্যাচে নতুন বলে বাংলাদেশকে ভুগিয়ে বোলিং র্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে ওঠা আকিল হোসেন এই ম্যাচে ছিলেন না। প্রথম চার ওভারে দারুণ সব শট খেলে পারভেজ ও লিটন দাস তোলেন ৪০ রান।
তিনটি নান্দনিক বাউন্ডারিতে নিজেকে ফিরে পাওয়ার ইঙ্গিত দিলেও লিটন শেষ পর্যন্ত হতাশ করেন আবার। উইকেট বিলিয়ে দেন ১৩ বলে ১৩ রান করে।
পরের ওভারে আলজারি জোসেফকে পুল করে ছক্কা মারার পর প্রিয় ফ্লিক শটে সীমানায় ধরা পড়েন পারভেজ। আগের ছয় টি-টোয়েন্টি মিলিয়ে তার রান ছিল ৪৯, স্ট্রাইক রেট ছিল ৭২। এবার তিনি করেন চারটি চার ও দুই ছক্কায় ২০ বলে ৩৯।
তিনে নামা তানজিদ হাসান আউট হয়ে যান গুডাকেশ মোটিকে একটি ছক্কা মেরেই। বাংলাদেশের রানের গতিও কমে যায় কিছুটা। পঞ্চম থেকে দশম, এই ছয় ওভারে রান আসে ৩৬।
মেহেদী হাসান মিরাজ চেষ্টা করেন রানের গতিতে দম দেওয়ার। কিন্তু তার ইনিংস থেমে যায় ২২ বলে ২৯ করে।
একটু পর শুরু হয় ‘জাকের-শো।’ এক পর্যায়ে তার রান ছিল ১৩ বলে ১০। চতুর্দশ ওভারে মোটিতে স্লগ সুইপে ছক্কা মেরে তার গতি বদলের শুরু। পরের ওভারে রান আউট থেকে বেঁচে যাওয়ার সেই ঘটনা। আগের দুই ম্যাচের নায়ক শামীম হোসেন এবার থামেন ২ রানে। এক বল পর রান আউট হয়ে যান শেখ মেহেদি হাসানও। ১৫ ওভার শেষে বাংলাদেশের রান ৬ উইকেটে ১১৪।
সেই নড়বড়ে অবস্থা থেকেই দলকে সর্বোচ্চ রানের চূড়ায় নিয়ে যান জাকের। তার ব্যাট থেকে বল আছড়ে পড়তে থাকে মাঠের নানা প্রান্তে। লং অন, মিড উইকেট, এক্সট্রা কাভার, কোথায় ছক্কা মারেননি তিনি! শেষ পাঁচ ওভারে তার ব্যাট থেকে আসে পাঁচটি ছক্কা দুটি চার! এর মধ্যে ৯৫ মিটার লম্বা ছক্কা ছিল ওবেড ম্যাককয়ের বলে।
সপ্তম উইকেটে তানজিম হাসানের সঙ্গে তার জুটিতে ৫০ রান আসে কেবল ২৭ বলেই। একটি করে চার ও ছক্কায় ১৭ রান করে অবদান রাখেন তানজিমও।
শেষ ওভারে জোসেফের বলে বাউন্ডারিতে পঞ্চাশ পেরিয়ে যান জাকের ৩৫ বলে। ওভারের শেষ চার বলে তিনি মারেন তিনটি ছক্কা।
শেষ ওভার থেকে আসে ২৫ রান। শেষ পাঁচ ওভারে বাংলাদেশ তোলে ৭৫।
রেকর্ড রান তাড়ার চ্যালেঞ্জে শুরু থেকেই পিছু হটতে থাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। আউটসুইঙ্গার দিয়ে ইনিংস শুরু করে তাসকিন আহমেদ দ্বিতীয় বলটি করেন ইনসুইঙ্গার। তাতেই আউট ব্র্যান্ডন কিং।
সিরিজের তিন ম্যাচেই কিংকে দ্রুত ‘বন্দি’ করলেন তাসকিন। পরের ওভারেই শেখ মেহেদি হাসানের শিকার অভিষিক্ত জাস্টিন গ্রেভস। জনসন চার্লস ও নিকোলাস পুরানের আল্টা আক্রমণে পরের তিন ওভারে রান আসে ৩৪। তবে বাংলাদেশ জবাব দিতে দেরি করেনি খুব একটা।
সিরিজে তৃতীয়বার পুরানকে (১০ বলে ১৫) আউট করেন শেখ মেহেদি। রোস্টন চেইসকে রান করতে দেননি হাসান মাহমুদ। চার্লসকে (১৮ বলে ২৩) সরাসরি থ্রোয়ে রান আউট করা রিশাদ হোসেন একটু পর বল হাতে বিদায় করেন রভম্যান পাওয়েলকে।
১৪ রানের মধ্যে ৪ উইকেট হারিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজের স্কোর তখন ৬ উইকেটে ৬০। এরপর রোমারিও শেফার্ডের ২৭ বলে ৩৩ রানের ইনিংসে ক্যারিবিয়ানরা একশ ছাড়ায়। কিন্তু বড় পরাজয় এড়ানো যায়নি।
ক্যারিয়ার সেরা ব্যাটিংয়ে ম্যাচের সেরা জাকের। ওভারপ্রতি স্রেফ ৫.৭৫ রান দিয়ে আট উইকেট নিয়ে সিরিজ-সেরা শেখ মেহেদি। আর এক পঞ্জিকাবর্ষে বাংলাদেশের রেকর্ড ৩৫ উইকেট নিয়ে বছর শেষ করলেন রিশাদ হোসেন।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৮৯/৭ (লিটন ১৪, পারভেজ ৩৯, তানজিদ ৯, মিরাজ ২৯, জাকের ৭২, শামীম ২, শেখ মেহেদি ০, তানজিম ১৭, রিশাদ ০; সিলস ২-০-১৮-০, শেফার্ড ৪-০-৩০-২, জোসেফ ৪-০-৫৯-১, চেইস ৪-০-১৫-১, মোটি ৩-০-৩০-১, ম্যাককয় ৩-০-৩৫-০)।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ১৬.৪ ওভারে ১০৯ (কিং ০, চার্লস ২৩, গ্রেভস ৬, পুরান ১৫, চেইস ০, পাওয়েল ২, শেফার্ড ৩৩, আকিল ৩১, মোটি ১২, জোসেফ ১, ম্যাককয় ৫, সিলস ৪*; তাসকিন ৩.৪-০-৩০-২, শেখ মেহেদি ৩-০-১৩-২, তানজিম ৩-০-৩১-১, হাসান ৩-০-৯-১, রিশাদ ৪-০-২১-৩)
ফল: বাংলাদেশ ৮০ রানে জয়ী।
সিরিজ: তিন ম্যাচের সিরিজে বাংলাদেশ ৩-০তে জয়ী।
ম্যান অব দা ম্যাচ: জাকের আলি।
ম্যান অব দা সিরিজ: শেখ মেহেদি হাসান।