ফিলিস্তিনের স্বাধীনতাকামী সশস্ত্র সংগঠন হামাসের সাবেক রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া নিহতের পর নতুন প্রধান হয়েছেন তাদের গাজা ভূখণ্ডের নেতা ইয়াহিয়া সিনাওয়ার। হানিয়া হত্যাকাণ্ডের জেরে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনা চরমে। ইরান হানিয়া হত্যার জন্য ইসরায়েলের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করেছে।
গত ৩১ জুলাই ইরানের রাজধানী তেহরানে ইসরায়েলি হামলায় নিহত হন হামাসের সাবেক রাজনৈতিক প্রধান ইসমাইল হানিয়া।
তার উত্তরসূরি হিসেবে হামাস তার গাজার নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ারকে দলটির রাজনৈতিক প্রধান হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।
ইসরায়েল ৩১ জুলাইয়ের হামলায় জড়িত থাকার বিষয়টি নিশ্চিত বা অস্বীকার করেনি।
গত বছরের ৭ অক্টোবর হামাস ইসরায়েলে যে ভয়াবহ হামলা চালায় তার মাস্টারমাইন্ডদের একজন সিনাওয়ার। তিনি বর্তমানে গাজায় লুকিয়ে আছেন। ইসরায়েলি সেনারা গাজায় গত ১০ মাস ধরে তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। কিন্তু এখনও তাকে ধরতে পারেনি।
সিনাওয়ারকে ইসরায়েলিরা এক নম্বর শত্রু হিসেবে গণ্য করে। হামাসের সব হামলার জন্য তাকেই হোতা হিসেবে গণ্য করে ইসরায়েল।
এমন একজন নেতাকে রাজনৈতিক ব্যুরোর প্রধান হিসেবে বেছে নেওয়ার মাধ্যমে হামাস ইসরায়েল সরকারের প্রতি অবজ্ঞার বার্তা পাঠাচ্ছে।
তবে সিনাওয়ার গাজায় লুকিয়ে থাকা অবস্থায় কীভাবে হামাসের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনা এবং যুদ্ধবিরতির আলোচনার তদারকি করবেন—তা নিয়ে প্রশ্ন নিয়ে উঠেছে। ইসরায়েল প্রকাশ্যেই তাকে হত্যার ঘোষণা দিয়েছে।
১৯৬২ সালে গাজার খান ইউনিসে জন্মগ্রহণ করা সিনওয়ারকে প্রায়ই হামাসের সবচেয়ে আপসহীন শীর্ষ নেতা হিসেবে চিত্রিত করা হয়। ১৯৮০-র দশকের শুরুতে গাজার ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তিনি ইসরায়েলের দখলদারত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। সেসময় ইসরায়েল তাকে বার বার গ্রেপ্তার করে।
গ্রাজ্যুয়েশনের পর তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার জন্য একটি যোদ্ধা নেটওয়ার্ক গড়ে তোলেন। সেই যোদ্ধা দলটিই পরবর্তী সময়ে হামাসের সামরিক শাখা কাস্সাম ব্রিগেডে পরিণত হয়।
১৯৮৭ সালে শেখ আহমেদ ইয়াসিন হামাস প্রতিষ্ঠার পরপরই সিনাওয়ার সংগঠনটিতে যোগ দেন। পরের বছরই ইসরায়েলি বাহিনী তাকে গ্রেপ্তার করে। তার বিরুদ্ধে দুজন ইসরায়েলি সেনা ও চারজন গুপ্তচরকে হত্যার অভিযোগ আনা হয়। তাকে চারটি যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়, যার মোট পরিমাণ ৪২৬ বছর।
সিনাওয়ার ২৩ বছর ইসরায়েলি কারাগারে আটক ছিলেন। সেখানে তিনি হিব্রু ভাষা শেখেন এবং ইসরায়েলিদের খুটিনাটি বিষয়-আশয় ও রাজনীতি বিষয়ে ব্যাপকভাবে জানেন। ২০১১ সালে এক বন্দী বিনিময় চুক্তির অংশ হিসেবে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। তার মুক্তির বিনিময়ে হামাসের হাতে বন্দী ইসরায়েলি সৈনিক গিলাদ শালিত মুক্তি পায়।
মুক্তির পর সিনাওয়ার দ্রুত আবার হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বে উঠে আসেন। ২০১২ সালে তিনি সংগঠনটির রাজনৈতিক ব্যুরোর সদস্য নির্বাচিত হন এবং কাস্সাম ব্রিগেডের সঙ্গে সমন্বয় করার দায়িত্ব পান।
২০১৪ সালে গাজার বিরুদ্ধে ইসরায়েলের ৭ সপ্তাহের যুদ্ধের সময় তিনি হামাসের নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক ও সামরিক ভূমিকা পালন করেছিলেন। পরের বছর যুক্তরাষ্ট্র সিনাওয়ারকে ‘বৈশ্বিক সন্ত্রাসী’ হিসেবে তকমা দেয়।
২০১৭ সালে সিনাওয়ার হামাসের গাজা শাখার প্রধান হন। তার আগে ইসমাইল হানিয়া ওই পদে ছিলেন। হানিয়া সে বছরই হামাসের রাজনৈতিক ব্যুরোর চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত হন। তার মানে, সিনাওয়ার যেভাবে হানিয়ার পর গাজা প্রধান হয়েছিলেন, একইভাবে হানিয়ার পর এবার তিনি হামাস প্রধানও হলেন।
ইসমাইল হানিয়াহ গত বছরের ৭ অক্টোবরের পর থেকে নিহত হওয়ার আগ পর্যন্ত গাজা যুদ্ধের সময় অব্যাহতভাবে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ভ্রমণ করেন। যুদ্ধ নিয়ে বক্তৃতা দেন। কিন্তু সিনাওয়ার গাজা যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান।
তবে ভাইস নিউজের সঙ্গে ২০২১ সালের এক সাক্ষাতকারে সিনাওয়ার বলেছিলেন, ফিলিস্তিনিরা যুদ্ধ চায় না। তবে তারা আগে ‘সাদা পতাকা ওড়াবে না’।
তিনি বলেন, “দীর্ঘ সময় ধরে আমরা শান্তিপূর্ণভাবে গণপ্রতিরোধের চেষ্টা করেছি। আমরা আশা করি যে, বিশ্ববাসী, মুক্ত মানুষেরা এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো আমাদের জনগণের পাশে দাঁড়াবে। ইসরায়েলি দলখলদারদের হত্যাকাণ্ড থেকে আমাদের জনগণকে বাঁচাবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত বিশ্ব শুধু চেয়ে চেয়ে দেখছে।”
সিনাওয়ার সম্ভবত ২০১৮ ও ২০১৯ সালে ইসরায়েল সীমান্তে গাজাবাসীর কয়েক মাস ধরে প্রতি সপ্তাহে প্রতিবাদ বিক্ষোভের কথা বলছিলেন। ইসরায়েল ওই বিক্ষোভের পর সহিংস দমনপীড়ন চালায়। এতে প্রায় ২২০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত ও আরও কয়েকশ জন আহত হয়।
হামাস যেভাবে ইসরায়েলে রকেট হামলা চালাত তাতে অনেক বেসামরিক ইসরায়েলিও মারা যেত। এমন নির্বিচার রকেট হামলাসহ হামাসের কৌশল সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে সিনাওয়ার বলেন, ফিলিস্তিনিরা তাদের হাতে যা আছে তা নিয়েই লড়ছে।
অন্যদিকে, ইসরায়েল অনেক উন্নত ও সুনির্দিষ্টভাবে হামলার অস্ত্র থাকা সত্ত্বেও ইচ্ছাকৃতভাবে হামাসের ওপর হামলার সময় ফিলিস্তিনি বেসামরিক নাগরিকদেরও হত্যা করে। এজন্য তিনি ইসরায়েলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগ করেন।
সিনাওয়ার বলেন, “বিশ্ব কী এটাই চায় যে, আমাদের ওপর গণহত্যা চালানোর পরও আমরা ভালো আচরণ করব, যাতে কোনও আওয়াজ ছাড়াই আমাদের হত্যা করা যায়?”
তথ্যসূত্র : আল জাজিরা